প্রাথমিক জীবন
জসিম ১৯৫০ সালের ১৪ আগস্ট তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলার বক্সনগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার প্রকৃত নাম আবদুল খায়ের জসিম উদ্দিন। লেখাপড়া করেন বিএ পর্যন্ত । 
মুক্তিযোদ্ধা
নায়ক জসিম ‘৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে একজন সৈনিক হিসেবে দুই নম্বর সেক্টরে মেজর হায়দারের নেতৃত্বে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। দেশের কান্ডারীর ভূমিকায় থেকে আবার চলচ্চিত্রের কান্ডারী হয়ে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন সমানতালে ।

অ্যাকশন ধারার প্রবর্তক
ভুড়িওয়ালা জসিম! শুনলে অবাক হবেন, সেই সত্তর দশকের ভুড়িওয়ালা জসিম ছিলেন বর্তমান বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে অ্যাকশন ধারার প্রবর্তক এবং ‘ফাইটিং গ্রুপ’ এর শুরুটা কিন্তু এই জসিমের হাত ধরেই । আজকের অনেক ফাইট ডিরেক্টর ও স্ট্যান্টম্যানরা জসিমের ছাত্র ছিলেন ।
চলচিত্র জীবন
জসিম আশির দশকে বাংলা চলচ্চিত্রে দর্শকপ্রিয়তা অর্জন করেন। জসিম চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করেন দেবর চলচ্চিত্রের মাধ্যমে ১৯৭২ সালে। এই ছবিতে জসিম চলচ্চিত্র পরিচালকদের দৃষ্টি আকর্ষন করেন। ১৯৭৩ সালে জসিম প্রয়াত জহিরুল হকের ‘রংবাজ’ (বাংলাদেশের প্রথম অ্যাকশন দৃশ্য যুক্ত করা ছবি) ছবিতে খলনায়ক হিসেবে অভিনেতা হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেন এবং যে ছবির অ্যাকশন দৃশ্যগুলোও ছিল তাঁর নিজস্ব প্রযোজনা সংস্থা জ্যাম্বস ফাইটিং গ্রুপের করা । স্বাধীনতার পর আধুনিক বাংলা চলচ্চিত্রের এগিয়ে যাওয়ার পেছনে জসিমের অবদান অনস্বীকার্য, কারণ, বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে অ্যাকশন ধারার প্রবর্তক এবং ‘ফাইটিং গ্রুপ’ এর শুরুটা জসিমের হাত ধরেই ।

নিজের কাজের প্রতি কতোটা উৎসর্গীয় ছিলেন তার উদাহরণ দেওয়ান নজরুলের ‘দোস্ত দুশমন’ ছবিতেই পাওয়া যায় । “দোস্ত দুশমন” ছবিটি হিন্দি সাড়াজাগানো ফিল্ম “শোলে” ছবির রিমেক । ছবিটিতে তিনি গব্বারের চরিত্র করেছিলেন । খোদ শোলে ফিল্মের নামকরা চরিত্র গব্বার সিং এর আদলে থাকা ভারতীয় খলনায়ক আমজাদ খান পর্যন্ত ভুয়সী প্রশংসা করেছিলেন জসিমের । তিনি দর্শকের মাঝে এতোটাই প্রভাব ফেলেছিলেন যে, ‘আসামি হাজির’ ছবির ডাকু ধর্মার সাথে ওয়াসিমের লড়াই দেখতে দর্শক সিনেমা হলের মূল গেইট ভেঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করেছিলো ।
মজার ব্যাপার হলো, তিনিই একমাত্র নায়ক, যিনি শাবানার সাথে একই সাথে প্রেমিক এবং ভাইরুপে চরিত্রদান করেছিলেন এবং দুটি চরিত্রই দর্শকেরা খুব সাদরে গ্রহণ করেছিলেন । উদাহরণস্বরুপ, যে শাবানা ‘সারেন্ডার’ ছবিতে জসিমের প্রিয়তমা হিসেবে সফল হয়েছেন, সেই শাবানা ‘অবদান’, ‘মাস্তান রাজার’ মতন ছবিতে জসিমের বড় বোন হয়ে সফল হয়েছিলেন ।
বর্তমানে দেখা যায় যে, নতুন নায়কের আবির্ভাব ঘটলেই বুড়ো হয়ে যাওয়া নায়কের কদর কমে যায়, কিন্তু এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিলেন জসিম । যেই নব্বইয়ের দশকে সালমান শাহ-ওমর সানিরা শেকড় গেঁড়েছিলো, সেই যুগেও জসিমের সিনেমা দেখতে হলে উপচে পড়া ভীড় থাকতো ।
তিনিই একমাত্র নায়ক যিনি একাধারে ধুন্ধুমার একশান দৃশ্য করে হাততালি কুড়িয়ে নিতেন আবার নায়ক হয়ে দর্শকদের আবেগে জড়াতেন, নীরবে অশ্রুবিয়োগের জন্য তাঁর অভিনয় ছিলো সাবলীল ।
আরেকটা তথ্য না দিলেই নয়, জসিমই আবিষ্কার করেছিলেন আজকের নায়ক রিয়াজকে ।
১৯৯৪ সালে রিয়াজ চাচাতো বোন ববিতার সাথে বিএফডিসি’তে ঘুরতে এসে নায়ক জসিমের নজরে পড়েন। জসিম তখন তাকে অভিনয়ের প্রস্তাব দেন এবং পরবর্তীতে জসিমের সাথে ‘বাংলার নায়ক’ নামের একটি ছবিতে ১৯৯৫ সালে অভিনয় করেন রিয়াজ ।

উল্লেখযোগ্য সিনেমাগুলো
তাঁর উল্লেখযোগ্য সিনেমাগুলো ছিলো, ‘সবুজ সাথি’, ‘সুন্দরী’, ‘কসাই’, ‘ছোটবৌ’, ‘মোহাম্মদ আলী’, ‘রকি’, ‘হিরো’, ‘অশান্তি’ , ‘বৌমা’ , ‘স্বামীর আদেশ’ , ‘টাকা পয়সা’ , ‘অভিযান’, ‘পরিবার’, ‘সারেন্ডার’, ‘ভাই আমার ভাই’, ‘ভাইজান’, ‘গর্জন’, ‘বিজয়’, ‘লালু মাস্তান’, ‘অবদান’, ‘ন্যায় অন্যায়’ , ‘লোভ লালসা’, ‘আদিল’, ‘কাজের বেটি রহিমা’ , ‘উচিৎ শিক্ষা’, ‘লক্ষ্মীর সংসার’, ‘মাস্তান রাজা ‘ , ‘কালিয়া’, ‘ওমর আকবর’, ‘ দাগি সন্তান’, ‘ সম্পর্ক’ , ‘শত্রুতা’, ‘নিষ্ঠুর’ , ‘পাষাণ’, ‘হিংসা’, ‘ভাইয়ের আদর’, ‘হাতকড়া’, ‘ডাকাত’, ‘বাংলার নায়ক’, ‘রাজাবাবু’, ‘রাজাগুণ্ডা’, ‘ঘাত প্রতিঘাত ‘ ‘স্বামী কেন আসামী’ সহ অসংখ্য অসংখ্য ছবি, যা বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখা থাকবে চিরকাল ।
ব্যক্তিগত জীবন
জসিমের প্রথম স্ত্রী ছিলেন ড্রিমগার্লখ্যাত নায়িকা সুচরিতা। পরে তিনি ঢাকার প্রথম সবাক ছবির নায়িকা পূর্ণিমা সেনগুপ্তার মেয়ে নাসরিনকে বিয়ে করেন।
জসীমের তিন ছেলে রাতুল, রাহুল, সামি । যার মধ্যে রাতুল ও সামি ‘Owned’ ব্যান্ডের বেইজিস্ট ও ড্রামার(Owned ইদানিং অনেক ট্রেন্ডিং ব্যান্ড) আর রাহুল ‘Trainwreck’ ব্যান্ডের গিটারিস্ট (এই ব্যান্ডের ড্রামারই অর্থহীনে যোগ দিয়েছে) আর ‘Poraho’r ড্রামার ।
মৃত্যু
জসিম ১৯৯৮ সালের ৮ই অক্টোবর মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত কারণে পরলোকগমন করেন। তার মৃত্যুর পর এফডিসির সর্ববৃহৎ ২ নম্বর ফ্লোরকে জসিম ফ্লোর নামকরণ করা হয় । 
সশ্রদ্ধ সালাম আর বিদেহী আত্মার প্রতি দোয়া রইলো ।
Share To:

Naim Khan

Post A Comment:

0 comments so far,add yours