রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে বিংশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কার্যকরী ছিল পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। একবিংশ শতাব্দীতে এসে সে চিত্র অনেকটাই বদলে গেছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে পৃথিবীর অনেকে দেশে গণতন্ত্র নামেমাত্র কার্যকর রয়েছে।

কর্তৃত্ববাদী সরকার ব্যবস্থা নিয়ে নির্মিত বিদ্রুপাত্মক চলচ্চিত্র 'দ্যা গ্রেট ডিক্টেটর'-এ অভিনেতা চার্লি চ্যাপলিন। চলচ্চিত্রটি ১৯৪০ সালে মুক্তি পায়।


বিংশ শতাব্দীর মতো অনেক দেশে সরাসরি সামরিক শাসন না থাকলেও, অনেক দেশে গণতান্ত্রিক-ভাবে নির্বাচিত সরকারগুলো সামরিক একনায়কদের মতোই আচরণ করছে বলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের পর্যবেক্ষণে বলা হচ্ছে।


অনেক দেশে পরিপূর্ণ বেসামরিক সরকার থাকলেও সেখানে গণতন্ত্র কতটা কার্যকরী আছে সেটি নিয়ে অনেক প্রশ্নের উদয় হয়েছে।

একটি দেশে বেসামরিক সরকার ক্ষমতায় থাকলেও সে দেশে গণতন্ত্র নাও থাকতে পারে। কিভাবে বুঝবেন একটি দেশে গণতন্ত্র নেই?

১. প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন:

গণতন্ত্রের মূল বিষয় হচ্ছে নির্বাচন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে নির্বাচন হলো 'গণতন্ত্রের প্রাণভোমরা' । সে নির্বাচন হতে হবে এবং অবাধ ও স্বচ্ছ। যে দেশে নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি এবং জবরদখল হয় সেটিকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বলতে নারাজ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা। 


২. একনায়করাও নির্বাচন করে:

যেসব দেশে বেসামরিক একনায়কতন্ত্র আছে সেখানেও নিয়মিত নির্বাচন হয়।
কারণ তথাকথিত নির্বাচনের মাধ্যমে শাসকগোষ্ঠী তাদের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার চেষ্টা অব্যাহত রাখে।
এখন নির্বাচনে কারচুপি শুধু জাল ভোটের মাধ্যমে ব্যালট বাক্স ভর্তি করা হয়না, এর নানা দিক আছে।
লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্সের গবেষক ব্রায়ান ক্লাস বলেন, নির্বাচনের সময় অধিকাংশ একনায়ক শাসক তাদের প্রতিন্দ্বন্দ্বিকে নানা কৌশলের মাধ্যমে নির্বাচনে অযোগ্য করে দেন।

৩. জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করা:

গণতন্ত্রে জনগণের মতামতের প্রাধান্য একটি বড় বিষয়। একটি সরকার নির্বাচিত হলেই গণতান্ত্রিক হয়না।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে গণতন্ত্র না থাকলে এবং একনায়কতন্ত্রের আবির্ভাব হলে জনগণের মতামতকে সহিংসভাবে দমনের চেষ্টা করা হয়।
এর ফলে জনগণ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ইয়াহিয়া আখতার বলেন, 'সিভিলিয়ান অটোক্র্যাট' বা 'বেসামরিক স্বৈরশাসক' বলে একটি কথা রাষ্ট্রবিজ্ঞানে চালু আছে। তিনি বলেন, "অনেক সময় গণতান্ত্রিক সরকারের চরিত্র দেখে অনেক সামরিক শাসকও লজ্জা পেতে পারে।"


২০১২ সালে নির্মিত কমেডি চলচ্চিত্র 'দ্য ডিক্টেটর''। এই চলচ্চিত্রে কাল্পনিক দেশ ওয়াদিয়ার স্বৈরশাসকের চরিত্রে অভিনয় করেন সাচা ব্যারন কোহেন। একটি দেশে একজন স্বৈরশাসকের পক্ষে কী কী নৈরাজ্য চালানো সম্ভব তা ঠাট্টা এবং তামাশাচ্ছলে চলচ্চিত্রটিতে তুলে আনেন পরিচালক।


৪.
ভোটার অংশগ্রহণ কমে যাবে:


দেশে গণতন্ত্র থাকেনা সেখানে শাসকগোষ্ঠী নিয়মিত নানা ধরণের নির্বাচন অনুষ্ঠান করলেও সেসব নির্বাচনের প্রতি মানুষের কোন আস্থা থাকেনা। ভোটাররা ভোট প্রদানের ক্ষেত্রে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। তারা ভোট দেবার জন্য ভোট কেন্দ্রে যেতে চায়না।

৫. সংসদ হবে একদলীয়:

রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে একটি দেশে যখন গণতন্ত্র থেকে বিচ্যুত হবার দিকে ধাবিত হয় তখন সংসদে ক্ষমতাসীনদের একচ্ছত্র আধিপত্য থাকে। সংসদে কার্যত কোন বিরোধী দল থাকেনা।

৬. নিরাপত্তা বাহিনীর প্রভাব:

রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে গণতন্ত্র না থাকলে দেশের নিরাপত্তা বাহিনীগুলো নানা ধরণের আইন-বহির্ভূত কাজ জড়িয়ে পরে। কারণ, শাসক গষ্ঠী তাদের ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য নিরাপত্তাবাহিনীকে রাজনৈতিক দমন-পীড়ন এবং সাধারণ মানুষকে দাবিয়ে রাখার কাজে ব্যবহার করে।

৭. দুর্বল প্রতিষ্ঠান:

অধ্যাপক ইয়াহিয়া আখতারের মতে গণতন্ত্র কায়েম করতে হলে কিছু প্রতিষ্ঠানকে কার্যকরী করতে হয়। যেমন: নির্বাচন কমিশন, সংসদ, বিচার বিভাগ ইত্যাদি। অধ্যাপক আখতার বলেন একটি দেশে যদি এসব প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক প্রভাব থাকে এবং সেগুলো ভঙ্গুর অবস্থার দিকে অগ্রসর হয়, তাহলে বুঝতে হবে সে দেশে গণতন্ত্র নেই।

৮. মতপ্রকাশে ভয় পাওয়া

গণতান্ত্রিক পরিবেশ না থাকলে স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে ভয়ের পরিবেশ তৈরি হয়। সেক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমও স্বাধীনভাবে কাজ করতে ভয় পায়। এমনকি শাসকগোষ্ঠী ইন্টারনেটও নিয়ন্ত্রণ করতে চায় যাতে করে মানুষ সেখানে নিজেদের মতামত প্রকাশ করতে না পারে।

৯. দুর্নীতি বেড়ে যাওয়া:

একনায়কতন্ত্রে দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার ঘটে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ক্রয় করার জন্য এই দুর্নীতি ব্যবহার করা হয়। এই ব্যবস্থায় দুর্নীতি এমন সুন্দরভাবে সাজানো হয় যে, সেটি অল্প কিছু ব্যক্তির উপর নির্ভর করে। শাসকের অনুগত হবার বিনিময়ে তাদের দুর্নীতি করার সুযোগ করে দেয়া হয়। ফলে তারা আরো ধনী হয়। যদি কোন কারণে সন্দেহ হয় যে তারা শাসকের অনুগত নয়,তখন তাদের দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করা হয়।

১০. ক্ষমতা হারানোর ভয়

একনায়ক শাসকরা অবসরের ভয়ে থাকেন। তাদের মনে থাকে যে ক্ষমতা হারানোর পর একটি অনিশ্চিত পরিস্থিতির তৈরি হবে। ফলে তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ প্রতিশোধ নিতে পারে।
Share To:

Naim Khan

Post A Comment:

0 comments so far,add yours