বর্তমান প্রজন্ম সোভিয়েত-আমেরিকার স্নায়ুযুদ্ধের উত্তাপ টের পায়নি। টের পাচ্ছে উত্তর কোরিয়া আর যুক্তরাষ্ট্রের ‘পারমাণবিক’ হম্বিতম্বির উত্তাপ। কিছুদিন আগে পর্যন্তও অবস্থা এতটা নাজুক ছিল না। তবে তখন যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন বারাক ওবামা। এখন যিনি প্রেসিডেন্ট হয়ে এসেছেন তিনি সোজা কথায় ওবামা নন। তিনি কূটকৌশলের চেয়ে বরং টুইটারে বাগযুদ্ধ করে সব কিছুর সমাধান করতে পছন্দ করেন। একদিকে উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ নেতা কিম জং উন তার স্বভাবজাত গর্জন করে যাচ্ছেন, অন্যদিকে সে গর্জনের লাগাসই জবাব দিয়ে বিশ্ববাসীর ঘুম হারাম করে ছেড়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। শত হোক তিনি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট। ছেড়ে কথা বলার লোক তিনি নন! তবে দুই নেতার এই বাকযুদ্ধকে যে যতই নিছক ‘কথার লড়াই’ বলে উড়িয়ে দিক না কেন, একটা চাপা উত্তেজনা কিন্তু ঠিকই ছড়াচ্ছে। একদিকে যুক্তরাষ্ট্র, যারা বর্তমান বিশ্বের তর্কসাপেক্ষে একমাত্র সুপারপাওয়ার। অন্যদিকে উত্তর কোরিয়া, যাদের রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ নেতা থেকে শুরু করে পারমাণবিক অস্ত্র পর্যন্ত সবই বেশ রহস্যময়। তবে এই রহস্যের মাঝে একটা ব্যাপার নিশ্চিত, আজকের এই পারমাণবিক যুদ্ধের উত্তেজনা দীর্ঘদিনের প্রক্রিয়ায় সৃষ্টি হয়েছে। সে প্রক্রিয়ারই পরিপ্রেক্ষিতে কিছু অতি জরুরি বিষয়ের উপর আলোকপাত না করলেই নয়।
উত্তর কোরিয়ায় পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির প্রক্রিয়ার শুরু কবে?
উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয় গত শতাব্দীর ৬০ এর দশক থেকে। উত্তর কোরিয়ার তৎকালীন প্রিমিয়ার এবং দেশের প্রতিষ্ঠাকালীন সর্বোচ্চ নেতা কিম ইল সাং পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির প্রক্রিয়া শুরু করার একটা প্রচেষ্টা চালান। এখানে দুটি বিষয় উল্লেখ করা জরুরি। ১৯৪৮ সালে উত্তর কোরিয়া প্রতিষ্ঠার বছর থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ নেতার পদ ছিল ‘প্রিমিয়ার’। ১৯৭২ সালে প্রিমিয়ার পদের বিলুপ্তি ঘটিয়ে প্রেসিডেন্ট পদের সূচনা করেন তৎকালীন প্রিমিয়ার কিম ইল সাং। পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় শাসন করা এক নায়কদের মধ্যে একজন এই কিম ইল সাং। তার পরবর্তীতে উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট হয়ে আসেন তার ছেলে কিম জং ইল। আর বর্তমানে দেশটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন তার দৌহিত্র কিম জং উন। যা হোক, কিম ইল সাং পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচী চালু করার জন্য তৎকালীন উত্তর কোরিয়ার সবচেয়ে বড় মিত্র সোভিয়েত ইউনিয়নের দ্বারস্থ হয়। কিন্তু স্নায়ুযুদ্ধের আবহে সোভিয়েত ইউনিয়ন কোরিয়াকে পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচী চালু করতে সাহায্য না করে বরং ‘নিউক্লিয়ার নন-প্রোলিফারেশন ট্রিটি’ তথা পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ নামক একটি চুক্তিতে সই করার পরামর্শ দেয়। উত্তর কোরিয়া অবশ্য সে পরামর্শে সায় দিয়ে সই করেছিল পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ করার চুক্তিতে।
কিম ইল সাং এর পুত্র কিম জং ইল ছিলেন বাবার চেয়ে কিছুটা আগ্রাসী। তিনি আর চুক্তি বা যুক্তরাষ্ট্রের হুমকির কথা বিবেচনা না করে পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচী শুরু করেন। তবে প্রাথমিকভাবে তা ছিল গোপনে। ২০০৩ সালে উত্তর কোরিয়া ঘোষণা দেয় যে তারা পারমাণবিক অস্ত্র রোধের সে চুক্তিটি থেকে সরে এসেছে এবং তারা একটি পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র হবার পথে এগোচ্ছে। তবে ১৯৯৪ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত কিম জং ইলের শাসনামলে উত্তর কোরিয়ায় পারমাণবিক অস্ত্র প্রক্রিয়া একরকম কচ্ছপ গতিতেই এগোচ্ছিল। কিন্তু এরপরই দৃশ্যপট দ্রুত বদলাতে থাকে। পিতামহ এবং পিতা, উভয়ের চেয়ে শতগুন বেশি আগ্রাসী কিম জং উন ২০১১ সালে উত্তর কোরিয়ার ক্ষমতা গ্রহণ করলে উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক কর্মসূচী রকেটের গতিতে এগিয়ে চলা শুরু করে। উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র ও মিসাইল কর্মসূচীর সিংহভাগই তার আমলে সাফল্য লাভ করে।
উত্তর কোরিয়ার বর্তমান পারমাণবিক সক্ষমতা–
যুক্তরাষ্ট্রের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্যমতে পিয়ংইয়ং এর কাছে বর্তমানে ৬০টির মতো পারমাণবিক বোমা রয়েছে। ২০০৬ সালে উত্তর কোরিয়া প্রথমবারের মতো পারমানবিক বোমার পরীক্ষা চালায়। এরপর থেকে দেশটি মোট ছয়বার পারমাণবিক বোমার পরীক্ষা চালিয়েছে। সম্প্রতি একটি পরীক্ষায় তারা এমন বিস্ফোরণ সৃষ্টি করে যা ১৯৪৫ সালে হিরোশিমায় যুক্তরাষ্ট্রের নিক্ষেপ করা ‘লিটল বয়’ এর বিস্ফোরণের দ্বিগুণ! অন্যদিকে সম্প্রতি বেশ কিছু আন্তমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালায় উত্তর কোরিয়া যার মধ্যে কয়কটি সফলও হয়। এসব ক্ষেপণাস্ত্র অন্তত কাগজে কলমে যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ডে আঘাত হানতে সক্ষম বলেই যুক্তরাষ্ট্রের যত চিন্তা। যদিও উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক সাফল্যের বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে, তবুও অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন যে উত্তর কোরিয়া পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র হবার দোরগোড়ায় এসে পৌঁছে গেছে।

যুক্তরাষ্ট্র কেন উত্তর কোরিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপ করছে না?
উত্তর কোরিয়া দিন দিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠছে। আর নিজেদের বিরুদ্ধে হুমকি কতটা নির্দয়ভাবে দমন করে যুক্তরাষ্ট্র তা ইরাক যুদ্ধে বিশ্ব দেখেছে। সামরিক সক্ষমতায় উত্তর কোরিয়া থেকে আলোক বর্ষ এগিয়ে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তথাপি তারা কেন পিয়ংইয়ং এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না? এই প্রশ্নের উত্তর আছে কোরিয়ান উপদ্বীপেই। যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশ দক্ষিণ কোরিয়া হতে পারে উত্তর কোরিয়া আর মার্কিনদের যুদ্ধের বলি। কোরিয় উপদ্বীপে দুই দেশকে পৃথক করা আড়াই মাইল প্রশস্ত ‘ডিমিলিটারাইজড জোন’ বা বেসামরিক অঞ্চল থেকে দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউলের দূরত্ব মাত্র ৩০ কিলোমিটার। ফলে সে অঞ্চলে থাকা উত্তর কোরিয়ান আর্টিলারির হাতের নাগালেই রয়েছে ২৫ মিলিয়ন জনসংখ্যার এই শহর। বিশ্লেষকদের ধারণা কোরিয় উপদ্বীপে যুদ্ধ বাঁধলে সিউলের সেই ২৫ মিলিয়ন মানুষ তার বলি হতে পারে। অন্যদিকে পারমাণবিক যুদ্ধ পৃথিবীর জন্য কতটা ভয়াবহ হবে তা অনুধাবন করা শক্ত নয়। আবার যদি এমন হয় যে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে উত্তর কোরিয়ার সামরিক শক্তি দ্রুত সময়ে ধ্বংস করে দিয়ে উত্তর কোরিয়া দখল করে নেয়, সেক্ষেত্রেও এই দখল করার প্রক্রিয়ায় পুরো উত্তর কোরিয়া জুড়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে হবে। ফলে যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে তৈরি হতে পারে স্মরণকালের ভয়াবহতম মানবিক বিপর্যয়। সম্ভবত এসব বিষয় বিবেচনায় বড় ধরণের যুদ্ধে জড়াতে চায় না যুক্তরাষ্ট্র।
যুদ্ধের সম্ভাবনা কতটুকু?
কিম জং উনের যুদ্ধ যুদ্ধ রবকে অধিকাংশই ‘ভয় দেখানো’র নীতি বলেই মনে করছেন। বিশ্লেষকদের মতে যুদ্ধের হুমকি দিয়ে কেবল জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা থেকে বের হতে চায় উত্তর কোরিয়া। সম্প্রতি উত্তর কোরিয়ার উপর নতুন করে যেসব নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে জাতিসংঘ তাতে করে উত্তর কোরিয়ার বাৎসরিক রপ্তানি আয় কমে যেতে পারে এক-তৃতীয়াংশ। কিন্তু এই নিষেধাজ্ঞার উপর একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন থাকছেই। কারণ রাশিয়া আর চীন এই নিষেধাজ্ঞা কতটুকু মানবে তা নিয়ে আছে সংশয়। অন্যদিকে এক দল রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করছেন যে উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক কর্মসূচী যুদ্ধের জন্য নয় বরং নিজেদেরকে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য। আবার এ কথাও সন্দেহ করা হচ্ছে যে পিয়ংইয়ং আদতে দুই কোরিয়ার একত্রীকরণ চায় যেখানে পিয়ংইয়ং এর নেতৃত্বে চলবে সমগ্র কোরিয়া। আর সেজন্যই তারা পারমাণবিক কর্মসূচী চালু রেখেছে। তবে সব তত্ত্ব একদিকে রেখে অন্তত এটা নিশ্চিত করে বলা যায় যে কোরিয় উপদ্বীপে এই উত্তেজনা বিশ্ববাসীর জন্য যথেষ্ট চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেননা ডোনাল্ড ট্রাম্প বা কিম জং উন, কারো উপরেই যে ভরসা রাখা যাচ্ছে না!
Post A Comment:
0 comments so far,add yours