পৃথিবীর বুকে অজানা রহস্য ঘেরা যত স্থানের নাম সবার কাছেই জানা তার মধ্যে অন্যতম বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল। আজ পর্যন্ত যত গবেষণা হয়েছে কোনো কিছুতেই এ রহস্য উদঘাটনের কোনো সুস্পষ্ট প্রমাণ মেলেনি। মানুষ সর্বদা জ্ঞানপিপাসু তাই অজানাকে জানা আর নতুন কিছু প্রমাণের যে স্পৃহা তা সর্বদা বিজ্ঞানীদের মধ্যে পরিলক্ষিত হলেও তরুণ মহলে আমাদের কাছে তা সর্বদাই আকর্ষণীয় একটা বিষয় হয়ে থাকে।


প্রথমেই বলে আসি বারমুডা ট্রায়াঙ্গল সম্পর্কে। 

বারমুডা ট্রায়াঙ্গল (Bermuda Triangle) : বারমুডা ট্রায়াঙ্গল পৃথিবীর এক রহস্যময় স্থান। বিভিন্ন সময় এ স্থানটিতে সামুদ্রিক জাহাজ ও উড়োজাহাজ হঠাৎ করে এমনভাবে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছে, যা পরবর্তিতে এ স্থানটিকে একটি ভৌতিক ও রহস্যময় স্থানে পরিণত করেছে। বহু রূপকথা, কিংবদন্তি এবং প্রামাণ্য গ্রন্থ রচিত হয়েছে এ নিয়ে। এমনকি ফিল্মও তৈরি হয়েছে এ নিয়ে।
রহস্যময় এ স্থানটির অবস্থান উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের পশ্চিম-উত্তর কোণে, মেস্কিকো সাগরের পূর্বে এবং শৈবাল সাগরের (seargassa sea) পশ্চিমে।


এ স্থানটি ত্রিভূজাকৃতির। যার পূর্ব-উত্তর কোণে রয়েছে ক্ষুদ্র দ্বীপপুঞ্জ বারমুডা। এই দ্বীপের নাম অনুসারেই এর নামকরণ করা হয় বারমুডা ট্রায়াঙ্গল (Bermuda Triangle)। পশ্চিম কোণে আছে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চল ফ্লোরিডা, মায়ামি উপকূল এবং দক্ষিণে পোর্টোরিকো দ্বীপপুঞ্জ (Puerto Rica Island)- এ তিনটি স্থানকে কাল্পনিক রেখা দ্বারা একত্র করলে Triangle বা ত্রিভূজের আকৃতির হয়। কেউ কেউ এর নাম দিয়েছে মৃত্যু ত্রিভূজ (The Devil’s Triangle)। কেউ বলে শয়তানের ত্রিভূজ।
বারমুডা দ্বীপ আবিষ্কার করেন বৃটিশ নাবিক জুয়ান ডি রার্মুডেজ, ১৫১৫ সালে। তারপর থেকে বৃটিশদের দূরপাল্লার সামরিক ও বাণিজ্যিক জাহাজগুলো এখানে কিছুদিন বিশ্রাম নিত। তখন থেকে এই দ্বীপপুঞ্জ আশপাশে নানা দুর্ঘটনা ঘটতে থাকে।


এরপর এই জায়গার কথা বলেন বিখ্যাত নাবিক কলম্বাস। তার বর্ণনামতে, তার জাহাজের নাবিকেরা বারমুডা ট্রায়াঙ্গল পাড়ি দেবার সময় দেখেছিল আলোর নাচানাচি আর আকাশে ধোঁয়া। এছাড়া কলম্বাস আরো লিখেছেন যে এই জায়গায় এসে তার কম্পাসও ভুল নির্দেশনা দিচ্ছিলো। আজ পর্যন্ত অসংখ্য জাহাজ এবং উড়োজাহাজ মিলিয়ে গেছে এই ট্রায়াঙ্গলে যার কোনো চিহ্ন আজও খুঁজে পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হয় এ পর্যন্ত ৫০টি বাণিজ্যিক জাহাজ ও ২০ টি বিমান হারিয়ে গেছে এই বারমুডা ট্রায়াঙ্গলে।



সর্বপ্রথম ৫ ডিসেম্বর, ১৯৪৫ সালে আমেরিকার পাঁচটি যুদ্ধবিমান ১৪ জনসহ মিলিয়ে যায় এই ট্রায়াঙ্গলে। সর্বশেষ তথ্যমতে খবর এসেছিল বিমানগুলো যখন এই অঞ্চলের খুব কাছাকাছি এসে পরে তারা বলছিলো তাদের সামনে খুবই ধোঁয়া, তারা কিছুই দেখতে পাচ্ছেনা এবং তাদের শেষ কথা ছিলো ’আমাদের বাঁচাও’। এ ঘটনার পর একদল অনুসন্ধান দল সেখানে পাঠানো হয়েছিল কিন্তু তাদের আজ পর্যন্ত কোনো খবর পাওয়া যায়নি। এছাড়া ১৯৪৭, ১৯৪৮, ১৯৪৯, ১৯৬২, ১৯৬৫, ২০০৫, ২০০৭ এবং ২০১৭ সালে ঘটে আরও বিমান দুর্ঘটনা। ১৮০০ সালে ঘটে প্রথম জাহাজ দুর্ঘটনা যেখানে প্রাণ হারায় ৯০ জনের মতো যাত্রী। এছাড়া ১৮১৪, ১৮২৪, ১৮৪০, ১৯১৮, ১৯২১, ১৯২৫, ১৯৪১, ১৯৬৩ এবং ২০১৫ সালে অসংখ্য প্রানহানি ঘটে এই ট্রায়াঙ্গলে। একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে যে, আজ অব্দি প্রায় ১০০০ জনের মতো বারমুডা ট্রায়াঙ্গল এর মাঝে প্রান হারিয়েছেন, যা গড়ে প্রতি বছরে ১০ জনের সমান।

এক নজরে দুর্ঘটনাগুলো-

১. ১৭৫০ সালে অক্টোবর মাসে সর্বপ্রথম ক্যাপ্টেন জুয়ানের নেতৃত্বে সেনাবোঝাই ৫টি জাহাজ ঝড়ের কবলে পড়ে ট্রায়াঙ্গল এলাকায় মারাত্মকভাবে বিধ্বস্ত হয়। এরপর ১৮৫৪ সালে বৃটিশ সামুদ্রিক জাহাজ বেল্লা (Bella) নিরুদ্দশ হয়ে যায়।
২. ১৮৬৬ সালে সুইডেনের মালবাহী জাহাজ ‘লুট্টা’ বারমুডা সমুদ্র এলাকায় রহস্যজনকভাবে ডুবে যায়।
৩. ১৮৭২ সালের ডিসেম্বর মাসে বৃটিশ বাণিজ্য তরী ম্যারি কোলেস্টে মারাত্মক দুর্ঘটনায় পড়ে।
৪. ১৮৮৮ সালে স্পেনের একটি বাণিজ্যপোত ভিয়াগো (Viego) নিখোঁজ হয়ে যায়।
৫. ১৯০২ সালে জামানির জাহাজ ফ্রেয়া (Freya) নিরুদ্দেশ হয়ে যায়।
৬. এভাবে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটতে থাকলেও মানুষের চোখে এটি রহস্যজনকভাবে ধরা পড়ে ১৫৪৫ সালে। যখন মার্কিন নৌবাহিনীর পাঁচটি জঙ্গিবিমান এ অঞ্চলে রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয়ে যায়। কথিত আছে, নিখোঁজ হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে পাইলট লেফটেন্যান্ট টয়লার কন্ট্রোল রুমে রাবার্ট কস্কের সাথে কথা বলছিলেন। শেষ মুহূর্তে তার ভয়ার্ত বক্তব্য ছিল এরকম ‘না না কস্ক তুমি সাবধান হও। তুমি কখনোই বিমান নিয়ে আমাদের খুঁজতে বের হবে না। তাহলে তোমরাও আমাদের মতো বিপদে পড়বে, ওরা অবিকল দেখতে অবিকল....।’ এরপর সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
৭. ১৯৬০ সালের দিকে বিপদগ্রস্ত হয় আমেরিকান সাবমেরিন স্করপিয়ন (Scorpion SSN9)। এভাবে বহু সামুদ্রিক জাহাজ, উড়োজাহাজ কখনো জড়ি চরমভাবে বিধ্বস্ত হয়েছিল অথবা অজ্ঞাত কারণে নিখোঁজ হয়েছিল বারমুডা অঞ্চলে বা তার আশপাশে।

একটি ধারণা সবার মধ্যে প্রচলিত আছে যে, বহিঃবিশ্বের কোনো অজানা প্রাণীর বাস সেখানে, যারা সর্বদা বসে আছে আশেপাশের সবকিছু গ্রাস করে নেবার জন্য। ধারণামতে ভিনগ্রহের মানুষেরা পৃথিবীতে এসে এ স্থানটিকে তাদের ঘাঁটি বানিয়ে নেয় এবং এ অঞ্চলের ভিতরে প্রবেশকারী সকল কিছুর চিহ্ন তারা গায়েব করে দেয় যাতে কেউ তাদের ব্যাপারে কিছুই জানতে না পারে। মজার বিষয় হিসেবে এই জায়গাকে তুলনা করা যেতে পারে ব্ল্যাকহোলের সাথে। যেখানে একবার কেউ প্রবেশ করলে বের হওয়া তো দূরের কথা তার কোনো অস্তিত্বও খুঁজে পাওয়া যায় না।


সর্বপ্রথম এই ট্রায়াঙ্গল সম্পর্কে একটি বই রচনা করেন লেখক ভিনসেন্ট এইচ গাদিস ১৯৬৫ সালে। বইটির নাম Invisible Horizon: True Mysteries of the Sea (1965)। এ বইয়ে তিনি নয়টি রহস্যে ঘেরা ঘটনার কথা বর্ণনা করেছেন। আজ পর্যন্ত বারমুডা ট্রায়াঙ্গল রহস্যকে ঘিরে দুইটি ইংরেজি চলচিত্র নির্মাণ হয়েছে। একটি হলো Lost in the Bermuda Triangle (1998) ও আরেকটি হলো Bermuda Tentacles (2014)

যদিও আজ অব্দি অনেক গবেষণা হয়েছে এই ট্রায়াঙ্গল সম্পর্কে, তারপরও সম্প্রতি একদল বিজ্ঞানীদের থেকে উঠে এসেছে বারমুডা ট্রায়াঙ্গল এর আসল রহস্য। তারা বর্ণনা করেছেন যে সমুদ্রের এ জায়গায় ষড়যন্ত্র মেঘ (Hexagonal Cloud) এর কারণে এক বায়ু গোলার সৃষ্টি হয় যার কারনে বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় ১৭০ কিলোমিটার ছাড়িয়ে যায়, যার কারনে আশেপাশের সবকিছু এই বিশাল ঢেউ সহ্য করতে না পেরে মিলিয়ে যায় আটলান্টিক সমুদ্রের বারমুডা ট্রায়াঙ্গল এর অতল গহ্বরে। এই গবেষণাটিকেই আজ পর্যন্ত সমস্ত গবেষণার ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়া হচ্ছে। 


এছাড়াও সাম্প্রতিক গবেষণায় এর কিছু যৌক্তিক ও প্রাকৃতিক ব্যাখ্যা বের হয়ে এসেছে। যেমন- ট্রায়াঙ্গল এলাকায় জাহাজে নাবিকদের কম্পাস বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়।
এর কারণ পৃথিবীর এমন কিছু অঞ্চল আছে, যেখানে ভৌগোলিক উত্তর আর চুম্বকীয় উত্তর হুবহু এক হয়ে যায়। যদিও চুম্বকীয় মেরু আর ভৌগোলিক মেরু হুবহু এক নয়। এই অস্বাভাবিক চুম্বকীয় ত্রুটির কারণে নাবিকদের ‘কম্পাস ভেরিয়েশনে’ বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়।
কার্ডিফ ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানীদের সাম্প্রতিক গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে চমৎকার একটি তথ্য- সমুদ্রের তলদেশে ব্যাপক মিথেন গ্যাস থাকে।

ধারণ করা হয়, সামুদ্রিক প্রাণিগুলোর মৃতদেহ থেকে এই মিথেন গ্যাস তৈরি হয়।
এই গ্যাস যখন সমুদ্রপৃষ্ঠে উঠে আসে, তখন কোনো জাহাজই সেখানে ভেসে থাকতে পারে না। ফলে জাহাজগুলো পূর্ব সংকেত ছড়ায় হঠাৎ করে ডুবে যেতে পারে। উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া বিমানগুলোর এতে মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। এমনকি আগুনও ধরে যেতে পারে। আর উপসাগরীয় সমুদ্রগুলোয় ক্ষতিগ্রস্ত যানসমূহকে মুহূর্তের মধ্যে ছিন্ন ভিন্ন করে বিলীন করে দিতে পারে।
বিশ্বে থেমে নেই কিছুই। থেমে থাকবে না এ রহস্যও আশা করা যায় সামনে নতুন কিছু কংক্রিট গবেষণার মাধ্যমে বের হয়ে আসবে নতুন আরো অজানা রহস্য, যার ফলশ্রুতিতে বাঁচানো যাবে অসংখ্য নিরীহ প্রাণ।

ছবি: ইন্টারনেট
Share To:

Naim Khan

Post A Comment:

0 comments so far,add yours