১৯৭৫ সালের ১৪ই জুন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পার্বত্য চট্টগ্রামের বেতবুনিয়ায় প্রথম উপগ্রহ ভূ-কেন্দ্র স্থাপন করেন, তখন আমাদের অংশগ্রহণ ছিল শুধু ব্যবহারকারী হিসেবে। আর সেখান থেকেই পরবর্তীকালে নিজস্ব স্যাটেলাইট অর্জনের ভিত রচিত হয়। ডিজিটাল বাংলাদেশের পথচলা শুরু সেখান থেকেই।
বাংলাদেশে প্রথম স্যাটেলাইট নিয়ে কাজ শুরু হয় ২০০৭ সালে। সে সময় মহাকাশের ১০২ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশে কক্ষপথ বরাদ্দ চেয়ে জাতিসংঘের অধীন সংস্থা আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ইউনিয়নে (আইটিইউ) আবেদন করে বাংলাদেশ। কিন্তু বাংলাদেশের ওই আবেদনের ওপর ২০টি দেশ আপত্তি জানায়।কিন্তু থেমে থাকেনি লাল সবুজের দেশ। তারই ফলাফল আমাদের বহুল প্রতীক্ষিত বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের এর উৎক্ষেপণ।
চলুন ধাপে ধাপে আমরা বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের বিস্তারিত তথ্য জানার পাশাপাশি বিশ্বের প্রথম স্যাটেলাইট, স্যাটেলাইটের কার্যাবলি এবং সেই সাথে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের উপকারিতা সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি ।
বিশ্বের প্রথম স্যাটেলাইটের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা
সময়টা ১৯৫৭ সাল, ৪ অক্টোবর, রাত ১০:২৯ । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের শক্তির ক্ষমতা সম্পর্কে বেশ ভালোভাবেই অবগত সবাই। সেই সাথে প্রযুক্তির দৌড়ে আরও এক ধাপ এগিয়ে গেল রাশিয়া। ইতিহাসের সর্বপ্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ ‘স্পুটনিক-১’ পৃথিবীর অভিকর্ষের মায়া কাটিয়ে চলে গেল তার নির্দিষ্ট কক্ষপথে। স্পুটনিক রুশ শব্দ, যার অর্থই হলো ‘উপগ্রহ’।
![]() |
A replica of Sputnik-1 at the US national air and space museum |
অনেকটা ভলিবল আকৃতির সেই কৃত্রিম উপগ্রহটির ভর ছিল ৮৩৬ কেজি মাত্র। তবে স্থায়ীত্ব বেশিদিন ছিল না, মাত্র তিন মাস। সর্বমোট ৭০ মিলিয়ন কিলোমিটার আবর্তনের পর পৃথিবীর বুকে ছিটকে পড়ে।
আর সেই থেকেই মানুষ মহাশুন্যে পাড়ি জমানোর এতদিনের স্বপ্নকে বাস্তবে দেখা শুরু করে। একের পর এক সব দেশ স্যাটেলাইট পাঠাতে থাকে। তারই ধারাবাহিকতায় ৫৬টি দেশ এই পর্যন্ত নিজস্ব স্যাটেলাইটের মালিক হয়েছে। আমাদের দেশ আজ ৫৭ তম নিজস্ব স্যাটেলাইটের অংশীদার।
বঙ্গবন্ধু-১ কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণের জন্য ২০১৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর তারিখ ঠিক করা হয়, তবে হারিকেন ইরমার কারণে ফ্লোরিডায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলে তা পিছিয়ে যায়। ২০১৮ সালেও কয়েক দফা উৎক্ষেপণের তারিখ পিছিয়ে যায় আবহাওয়ার কারণে।
চূড়ান্ত পর্যায়ে উৎক্ষেপণ প্রস্তুতির অংশ হিসেবে ৪ মে ২০১৮ তারিখে ফ্লোরিডার কেনেডি স্পেস সেন্টারে দুই পর্যায়ের এই রকেটের স্ট্যাটিক ফায়ার টেস্ট সম্পন্ন হয়। কৃত্রিম উপগ্রহটি ১০ মে ২০১৮ তারিখে উৎক্ষেপণের তারিখ ঠিক করা হয়; কিন্তু ১০ মে উৎক্ষেপণের সময় t-৫৮ সেকেন্ডে এসে তা বাতিল করা হয়। শেষ মিনিটে কিছু কারিগরি সমস্যার কারণে উৎক্ষেপণ স্থগিত করা হয়। অবশেষে এটি ১১ মে উৎক্ষেপণ করা হয়।
কৃত্রিম উপগ্রহটি উৎক্ষেপণ করার পর, বাংলাদেশ ১২ মে ২০১৮ তারিখে এটি থেকে পরীক্ষামূলক সংকেত পেতে শুরু করে।
বঙ্গবন্ধু-১ এর বৈশিষ্ট্য, উৎক্ষেপণ এবং কিছু তথ্য
বঙ্গবন্ধু-১ হলো আমাদের দেশের প্রথম একটি ভূ-স্থির যোগাযোগ উপগ্রহ বা সহজ কথায় কৃত্রিম উপগ্রহ যা যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডাতে অবস্থিত ক্যাপ ক্যানাভেরাল-এর ‘কেনেডি স্পেস সেন্টার,লঞ্চ প্যাড ৩৯এ’ থেকে উৎক্ষেপিত হয়।বঙ্গবন্ধু-১ কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণের জন্য ২০১৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর তারিখ ঠিক করা হয়, তবে হারিকেন ইরমার কারণে ফ্লোরিডায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলে তা পিছিয়ে যায়। ২০১৮ সালেও কয়েক দফা উৎক্ষেপণের তারিখ পিছিয়ে যায় আবহাওয়ার কারণে।
চূড়ান্ত পর্যায়ে উৎক্ষেপণ প্রস্তুতির অংশ হিসেবে ৪ মে ২০১৮ তারিখে ফ্লোরিডার কেনেডি স্পেস সেন্টারে দুই পর্যায়ের এই রকেটের স্ট্যাটিক ফায়ার টেস্ট সম্পন্ন হয়। কৃত্রিম উপগ্রহটি ১০ মে ২০১৮ তারিখে উৎক্ষেপণের তারিখ ঠিক করা হয়; কিন্তু ১০ মে উৎক্ষেপণের সময় t-৫৮ সেকেন্ডে এসে তা বাতিল করা হয়। শেষ মিনিটে কিছু কারিগরি সমস্যার কারণে উৎক্ষেপণ স্থগিত করা হয়। অবশেষে এটি ১১ মে উৎক্ষেপণ করা হয়।
কৃত্রিম উপগ্রহটি উৎক্ষেপণ করার পর, বাংলাদেশ ১২ মে ২০১৮ তারিখে এটি থেকে পরীক্ষামূলক সংকেত পেতে শুরু করে।
বাংলাদেশ ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীনে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন কর্তৃক বঙ্গবন্ধু-১ প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়। এর প্রধান কন্ট্রাক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে স্পারসো (SPARRSO)। বাংলাদেশ সরকার ২০১৫ সালের ১১ই নভেম্বর ‘’থ্যালেস অ্যালেনিয়া স্পেস’’ নামক এক ফরাসি কোম্পানির সাথে যাবতীয় যন্ত্রপাতির ডিজাইন বা নকশার জন্য চুক্তি করে।
বিটিআরসিকে শুধু ডিজাইন এবং যন্ত্র নির্মানের জন্য গুনতে হয়েছে প্রায় ১ হাজার ৯৫১ কোটি টাকা। তবে প্রকল্প বাস্তবায়নে সর্বমোট খরচ প্রায় ২ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা যার অর্ধেক সরকারি তহবিলের মাধ্যমে এবং বাকি অর্ধেক বিদেশি সংস্থার কাছে থেকে প্রাপ্ত।
এই কৃত্রিম উপগ্রহটির সর্বমোট ৪০টি ট্রান্সপন্ডার ব্যান্ড আছে । হয়তো মনে প্রশ্ন জাগতে পারে ট্রান্সপন্ডার ব্যান্ড কী । একদম সহজ! ধরুন একটি প্রেরক অ্যান্টেনা এবং আরেকটি প্রাপক অ্যান্টেনা । এই দু’য়ের মধ্যে একটি যোগাযোগ চ্যানেল গঠন, যা ইন্টার-কানেক্টেড ইউনিট সিরিজে যুক্ত থাকে ।
৪০ টি ট্রান্সপন্ডার ব্যান্ডের মধ্যে ১৪টি ‘সি’ ব্যান্ড এবং ২৬টি ‘কেইউ’ ব্যান্ড। সর্বমোট ৪০টি ব্যান্ডের মধ্যে ২০টি ব্যান্ড নিজেদের জন্য এবং বাকি ২০টি ব্যান্ড বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রির জন্য রাখা হয়েছে। এটি ৪০০০বি২ স্পেসবাস প্লাটফর্মের।
১৬০০ ওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন(যার উৎস ২টি সৌর ব্যাটারি) স্যাটেলাইটটির ভর ১৩০০ কেজি হলেও বাহক রকেটসহ উৎক্ষেপণ ভর ছিল প্রায় ৩৬০০ কেজি ।
স্পেস এক্স এবং বঙ্গবন্ধু-১
এবার আসি স্পেস এক্স এর কথায়। এলন মাস্ক, যাকে আমরা কমবেশি সবাই চিনি। বর্তমানে প্রযুক্তির বরপুত্র বলা হয় কাকে? উত্তরটি চোখ বন্ধ করেই বলে দেয়া যায় বর্তমান সময়ের অন্যতম সেরা উদ্ভাবক এবং বিখ্যাত স্পেস এক্স এর কর্ণধার এলন মাস্কের নাম। যিনি ‘হাইপারলুপ’ নামক একটি নকশার পরিকল্পনা করেছেন যেখানে একটি বিশেষ টিউবের মধ্য দিয়ে দ্রুতগতির ট্রেন সিস্টেম পরিচালিত হবে। এলন মাস্কের আরো একটি বড় পরিচয় হচ্ছে তিনি ‘টেসলা মটরস’ এরও প্রধান নির্বাহী।
বলতে গেলে দ্রুতগতির যোগাযোগ ব্যবস্থার বর্তমান রক্ত মাংসের একক হচ্ছেন ‘এলন মাস্ক’। নাসার সাথে একযোগ হয়ে মঙ্গলে মানুষ পাঠানোর পরিকল্পনায় মত্ত এই স্বপ্নবাজ মানুষেরই রকেট নির্মাতা প্রতিষ্ঠান স্পেস এক্স। আর এই স্পেস এক্স হলো আমাদের দেশের প্রথম যোগাযোগ উপগ্রহ ‘বঙ্গবন্ধু-১’ এর লঞ্চ অপারেটর। অর্থাৎ উৎক্ষেপণ থেকে শুরু করে নির্দিষ্ট কক্ষপথে পৌঁছে দেয়ার গুরু দায়িত্ব কোম্পানিটির উপরে।
আর তাই আমাদের বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটটি স্পেস এক্স-এর তৈরি ‘ফ্যালকন-৯’ নামক রকেটের স্পেস শাটলের কার্গো বে এর মাধ্যমে মহাকাশে পাঠানো হয়েছে। ফ্যালকন হচ্ছে একটি রকেট পরিবার যেখানে ৩ ধরণের ফ্যালকন রকেটের সমাহার দেখা যায়।
‘ফ্যালকন-১, ফ্যালকন-৯ এবং ফ্যালকন হেভি’। তবে আমাদের বঙ্গবন্ধু-১, ৬ কিলোওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ফ্যালকন -৯ রকেটের অত্যাধুনিক ১.২ ভার্সনের(ফুল থ্রাস্ট) নাকের ডগায় অবস্থান নিয়ে উড়াল দিয়েছিল পৃথিবী থেকে।
উৎক্ষেপণের মাত্র ৮ মিনিটের মাথায় রকেটের নিচের অংশ পৃথিবীতে ফেরত আসে এবং উপরের স্যাটেলাইট চেম্বার নিয়ে যায় তার গন্তব্যস্থলে। সেখানে ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন (ISS)-এ পৌঁছার পর প্রয়োজনীয় ধাপ পার করে একে নির্দিষ্ট কক্ষপথে ছেড়ে দেয়া হয়। স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণে ফ্যালকন-৯ রকেট বেশ সফল। তবে মহাকাশে সর্বপ্রথম গাড়ি টেসলা রোডস্টার পাঠানো হয় কিন্তু ফ্যালকন-হেভি নামক রকেটের সাহায্যে।
স্যাটেলাইটের কাজ এবং ধরণ:
আমরা জানি একটি স্যাটেলাইট পৃথিবীর চারদিকে ডিম্বাকার পথে পরিভ্রমণরত থাকে। তবে একে উৎক্ষেপণের পর একটি নির্দিষ্ট দ্রুতি প্রদান করা হয় যাতে কক্ষপথে ঘুরতে থাকে এবং কেন্দ্রমুখী বলের মাধ্যমে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে।
আমরা পদার্থবিজ্ঞানে পড়েছি যে কোনো বস্তুকে ১১.২ কি.মি/সেকেন্ড বেগে উপরে নিক্ষেপ করলে তা আর পৃথিবীতে ফেরত আসে না। অর্থাৎ চাঁদের মত পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে। কিন্তু একটি স্যাটেলাইটকে ২৫০ কি.মি. উপরে তুলে এবং পৃথিবী পৃষ্ঠের সমান্তরালে এমন ভাবে উৎক্ষেপ করতে হয় যেন তা প্রতি সেকেন্ডে ৮ কি.মি পথ অতিক্রান্ত করে। যা রকেটের সাহায্য ছাড়া একদমই অসম্ভব।
সাধারণত পৃথিবী থেকে রেডিও অ্যাকটিভ বা বেতার তরঙ্গ ব্যবহারের মাধ্যমে স্যাটেলাইটে তথ্য প্রেরণ করা হয়। সেক্ষেত্রে স্যাটেলাইট তখন প্রাপক যন্ত্র হিসেবে কাজ করে এবং রিসিভ করা উপাত্তকে বিবর্ধিত করে পুনরায় পৃথিবীতে প্রেরণ করে। স্যাটেলাইট থেকে আসা সিগন্যাল কিছুটা কম শক্তিসম্পন্ন যার জন্য প্রথমে ডিশ অ্যান্টেনা ব্যবহার করে প্রাপ্ত সিগন্যালকে কেন্দ্রীভূত করা হয় এবং রিসিভার দিয়ে গ্রহণ করে পরবর্তী কাজগুলো সম্পন্ন হয়। আমরা নিরবিচ্ছিন্ন টেলিযোগাযোগ সেবা পেয়ে থাকি।
বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট হচ্ছে জিওস্ট্যাশনারি কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট যা শুধুমাত্র যোগাযোগ ক্ষেত্রে অর্থাৎ তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ, টেলিভিশন সম্প্রচার ইত্যাদি ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে। তবে আপাতত আবহাওয়া সম্পর্কিত কোনো উপাত্ত সংগ্রহে ভূমিকা রাখতে পারছে না বঙ্গবন্ধু-১।
এছাড়াও আরও বিভিন্ন ধরনের স্যাটেলাইট আছে। মিলিটারি, ওয়েদার, ন্যাভিগেশন, আর্থ অবজারভেশন সহ আরও বিভিন্ন স্যাটেলাইট কাজের ধরন অনুযায়ী মহাকাশে স্থাপন করা হয়। এক এক স্যাটেলাইটের কাজের ধরণ বিবেচনায় এক এক উচ্চতায় স্থাপন করা হয়। তবে বিভিন্ন স্যাটেলাইটের কাজে ভিন্নতা থাকলেও প্রতিটি স্যাটেলাইটেরই শক্তির উৎস হচ্ছে সূর্য। এদের গায়ে সৌরকোষ লাগানো থাকে যার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় শক্তি গ্রহণ করে তথ্য প্রেরণে ভূমিকা রাখে।
কমিউনিকেশন এবং ভূ-স্থির স্যাটেলাইট কী?
এক কথায় যোগাযোগ সম্পন্নের জন্য যে স্যাটেলাইট। একটু বুঝিয়ে বলি। আপনি যদি কোনো স্যাটেলাইটকে পৃথিবীপৃষ্ঠ হতে প্রায় ৩৫ হাজার ৭৮৬ কি.মি. উচ্চতায় স্থাপন করেন তবে তার পৃথিবীর চারদিকে সমবেগে একবার আবর্তন করতে সময় লাগবে ২৪ ঘন্টা(২৩ ঘণ্টা ৫৬ মিনিট ৪ সেকেন্ড)। আবার পৃথিবীও নিজ কক্ষপথে চারদিকে একবার ঘূর্ণন সম্পন্ন করতে সময় নেয় ২৪ ঘন্টা। তার মানে পৃথিবীর সাপেক্ষে আপনি ভূ-উপগ্রহকে দেখলে মনে হবে স্থির হয়ে আছে। আর যেহেতু ভূপৃষ্ঠের সাপেক্ষে কক্ষপথ স্থির সেহেতু এই কক্ষপথের নাম হচ্ছে জিওস্ট্যাশনারি অরবিট বা ভূ-স্থির কক্ষপথ।
তবে একটু সমস্যা আছে । আমাদের পৃথিবীর আকৃতিগত বক্রতার কারণে এই ধরণের শুধু একটি স্যাটেলাইট যোগাযোগ রক্ষার্থে পুরো পৃথিবীকে সেবাদান করতে পারে না ।
সেক্ষেত্রে তিনটি স্যাটেলাইটকে পরষ্পর ১২০ ডিগ্রি কোণে জিও স্ট্যাশনারী অরবিটে স্থাপনের মাধ্যমে সহজেই পুরো পৃথিবীর কভারেজ প্রদান সম্ভব।
কমিউনিকেশন স্যাটেলাইটের মাধ্যমে আমাদের টেলিভিশন সম্প্রচার, টেলিযোগাযোগ, রেডিও বার্তা প্রদান, দ্রুতগতির নিরবিচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সেবা ইত্যাদি নিশ্চিত হবে।
আর আমাদের বঙ্গবন্ধু-১ হচ্ছে ঠিক এরকম ভূ-স্থির কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট।
বঙ্গবন্ধু-১ এর কক্ষপথ
২০১১ সালে বাংলাদেশের পাঠানো ভবিষ্যত স্যাটেলাইটের জন্য আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ইউনিয়ন (আইটিইউ) ১০২ ডিগ্রি পূর্ব স্লট নির্ধারন করেছিল। সেক্ষেত্রে রাশিয়ান সর্ববৃহৎ স্যাটেলাইট কোম্পানি ‘ইন্টারস্পুটনিক’ এর কাছ থেকে অরবিটাল স্লটের জন্য চুক্তিও করা হয়। আমাদের দেশ সবসময়ই চেয়েছিল স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণে যেন ১০২ ডিগ্রি পূর্ব স্লটকেই দেয়া হয়।
কিন্তু দু:খের বিষয় সেই সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, রাশিয়া সহ প্রায় ২০টি দেশ বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের জন্য আপত্তি প্রকাশ করে। তবে তার মূল কারণ ছিল ১০২ ডিগ্রি স্লট নিয়ে। কারণ ১০২ ডিগ্রির আশেপাশে অন্যান্য স্যাটেলাইটের অবস্থানের কারণে বাংলাদেশের স্যাটেলাইট এবং সেই সাথে অন্যান্য স্যাটেলাইটেও ফ্রিকোয়েন্সি পেতে সমস্যা হতে পারে।
তখন আমাদের দেশ পুনরায় ভিন্ন একটি উপায় বের করে এবার ৬৯ ডিগ্রিতে আবেদনের চিন্তা করে। কিন্তু তা বাতিল করতে হয় সিঙ্গাপুর, চীন এবং মালয়েশিয়ার সম্ভাব্য আপত্তির কারণে। তাই স্পুটনিকের কাছ থেকে ১১৯.১ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশ স্লট কিনে নেয়া হয়, যার জন্য খরচ পড়েছে প্রায় ২১৯ কোটি টাকা (২.৮০ কোটি মার্কিন ডলার)। কিন্তু আমাদের দেশের অবস্থান ৯০ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশে বিধায় স্যাটেলাইটের অবস্থান হয় ইন্দোনেশিয়া বরাবর।
আমাদের এই স্যাটেলাইটের প্রাথমিক মেয়াদ ধরা হয়েছে ১৫ বছর। এর মানে হলো ‘স্পুটনিক’ আমাদেরকে তাদের ১১৯.১ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমারেখাকে ১৫ বছরের জন্য ভাড়া দিয়েছে। তবে আরও দু’বার ১৫ বছর করে আরও ৩০ বছর পর্যন্ত কক্ষপথ কেনা যাবে। সেক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ সরকার আরও দুটি স্লটের জন্য আবেদন করবে। স্লট দুটি হলো ৬৯ ডিগ্রি পূর্ব এবং ১৩৫ ডিগ্রি পূর্ব। অদূর ভবিষ্যতে আরও ২টি স্যাটেলাইট স্থাপনের মাধ্যমে পুরো পৃথিবীর কভারেজ নেয়া সম্ভব হবে।
তাই আপাতত ১১৯.১ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশ কক্ষপথেই স্থাপিত হয় আমাদের লাল সবুজের গর্বের বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট।
বঙ্গবন্ধু-১ নিয়ন্ত্রণের গ্রাউন্ড স্টেশন:
একটি স্যাটেলাইটকে কক্ষপথে ছেড়ে দিলেই যদি কাজ শেষ মনে করেন, তবে ভুল ভাবছেন। একে কন্ট্রোল করতে হয়। ২৪ ঘণ্টা রক্ষণাবেক্ষণ না করলে যেকোনো সময় কক্ষপথ থেকে ছিটকে পড়তে পারে। আর সেই লক্ষ্যে আমাদের দেশ থেকেই বঙ্গবন্ধু-১-কে নিয়ন্ত্রণ এবং রক্ষণাবেক্ষণ করছে দেশের সেরা ১৮ জন স্যাটেলাইট প্রকৌশলী। গ্রাউন্ড স্টেশন দু’টি হলো ঢাকার অদূরে গাজীপুর জেলার জয়দেবপুরের বিসিএসসিএল এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি জেলার ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র।
ফ্রান্সের থ্যালেস অ্যালেনিয়া ৩ বছরের জন্য একে রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিলেও মূল কাজ সম্পাদিত হয় জয়দেবপুরের গ্রাউন্ড স্টেশন থেকেই।
বাংলাদেশের ভবিষ্যতে বঙ্গবন্ধু-১ :
প্রযুক্তিগত উন্নয়নে মানুষের কল্যাণের পরিধি কখনোই ছোট হয় না। যে দেশ প্রযুক্তিতে যত বেগবান, সেই দেশ ততো বেশি সমৃদ্ধশালী। রাশিয়ার ইতিহাসে চোখ রাখলেই প্রমাণ পাওয়া যাবে। আমাদের দেশে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে। অর্থাৎ যোগাযোগের ব্যবস্থাও উন্নত হচ্ছে। তার মানে স্যাটেলাইটের ব্যবহারও বাড়ছে। কিন্তু আমরা সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশের স্যাটেলাইট সেবা ভাড়া নিয়ে ব্যবহার করে আসছি, যার জন্য সরকারকে প্রতি বছর গুণতে হয় ১২৫ কোটি টাকা। তাহলে একবার ভাবুন দেশের নিজস্ব স্যাটেলাইটের প্রয়োজনীয়তা কতটুকু!
একটি হিসেবে দেখা যায় বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের সেবায় শুধু বৈদেশিক মুদ্রাই সাশ্রয় হবে না, উপরন্তু এর কিছু অব্যবহৃত অংশ মায়ানমার, নেপাল, ভূটানের মতো দেশে ভাড়া দিয়ে প্রতি বছর ৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করা সম্ভব। যার ফলে বঙ্গবন্ধু-১ প্রকল্পের সর্বমোট খরচ তুলতে ৫-৭ বছরের বেশি লাগবে না। এখন আর আমাদেরকে অন্য দেশের স্যাটেলাইটের উপর নির্ভর করে চলতে হবে না। টেলিভিশন সম্প্রচারের খরচও অনেকটা কমে যাবে।
এছাড়াও কিছু কিছু ক্ষেত্র যেমন টেলিমেডিসিন, ই-লার্নিং, ই-গবেষণা, ভিডিও কনফারেন্স, প্রতিরক্ষা ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা উন্নত হবে। প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় তথ্য আদান-প্রদানে গোপনীয়তা অত্যন্ত জরুরি যেখানে বিশ্বের অন্যান্য দেশ ‘স্যাটেলাইট ফোন’ ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু আমাদের দেশের জন্য এই প্রথম বারের মত নিজস্ব স্যাটেলাইট ব্যবহার করার মাধ্যমে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় নিরবিচ্ছিন্ন যোগাযোগ রক্ষা এবং গোপনীয়তা বজায় রাখা সম্ভব হবে।
কমিউনিকেশন স্যাটেলাইটের অন্যতম সেবা হচ্ছে দূর্যোগের সময়েও দ্রুতগতির ইন্টারনেট প্রদান যা বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থায় কম খরচ সহ প্রযুক্তিখাতে এক নতুন ভিত্তি রচনা করবে। প্রাকৃতিক দূর্যোগে দেশের অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্থ হলেও এই স্যাটেলাইট প্রয়োজনীয় ‘ই-সেবা’ প্রদান করে জরুরি মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।ইতিমধ্যে ঘূর্ণিঝড় ফণী মোকাবেলায় এই স্যাটেলাইট সাফল্যের সাথে ব্যবহার করা হয়েছে। প্রযুক্তির এই দুনিয়ায় বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট আমাদের দেশের ভবিষ্যতের জন্য একটি সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিচ্ছে, এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।
বঙ্গবন্ধু ১ স্যাটেলাইট থেকে ৩ ধরনের সুবিধা পাওয়া যাবে।
টিভি চ্যানেলগুলো তাদের সম্প্রচার কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য স্যাটেলাইট ভাড়া করে। এক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট চ্যানেলের সক্ষমতা বিক্রি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হবে। আবার দেশের টিভি চ্যানেলগুলো যদি এই স্যাটেলাইটের সক্ষমতা কেনে তবে দেশের টাকা দেশেই থাকবে। এর মাধ্যমে ডিটিএইচ বা ডিরেক্ট টু হোম ডিশ সার্ভিস চালু সম্ভব। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের ৪০টি ট্রান্সপন্ডারের মোট ফ্রিকোয়েন্সি ক্ষমতা হলো ১ হাজার ৬০০ মেগাহার্টজ। এর ব্যান্ডউইডথ ও ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার করে ইন্টারনেটবঞ্চিত অঞ্চল যেমন পার্বত্য ও হাওড় এলাকায় ইন্টারনেট সুবিধা দেয়া সম্ভব। প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইন্টারনেট ও ব্যাংকিং সেবা, টেলিমেডিসিন ও দূরনিয়ন্ত্রিত শিক্ষাব্যবস্থা প্রসারেও ব্যবহার করা যাবে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট। বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় মোবাইল নেটওয়ার্ক অচল হয়ে পড়ে। তখন এর মাধ্যমে দুর্গত এলাকায় যোগাযোগব্যবস্থা চালু রাখা সম্ভব হবে।
বঙ্গবন্ধু ১ স্যাটেলাইট থেকে ৩ ধরনের সুবিধা পাওয়া যাবে।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours