এখন আমাদের প্রশ্ন হল, চাঁদের দেহ কাল কেন? বিজ্ঞান এ বিষয়ে নীরব; উপরন্ত চাঁদের জন্ম ইতিহাস প্রসঙ্গে বিজ্ঞান বলছে চাঁদ পৃথিবীরই অংশ। সে হিসেবে চাঁদের মাটির রং আমাদের পৃথিবীর মতই হওয়া উচিত,কিন্তু তা না হয়ে হয়েছে কুচকুচে কাল। বিজ্ঞান বলছে, চাঁদ সূর্যের আপতিত আলোকে প্রতিফলিত করে বলেই তাকে আমরা আলোক উৎসের মত উজ্জল দেকতে পাই। বিজ্ঞান আরও বলছে, কোন শুভ্র প্রতিফলক কাল পতিফলকের চেয়ে বেশী আলো প্রতিফলিত করে। বিজ্ঞানের এই ধারণা তেকে বলা যায় যে, চাঁদ কাল বলে তা থেকে যৎ সামান্য আলো প্রতিফলিত হয়ে আমাদের চোখে পড়ে, এ বস্তটি শুভ্র হলে তাকে অনেকটা মিনি সূর্যের মতমনে হত এবং তার আলোয় আমাদের রাতের আকাশ অনেকটা দিনের মত হয়ে উঠত। তাহলে কি ধরে নেওয়া যায় যে, পৃথিবীর রাত্রিকালীন সময়কে উপযুক্ততা দান করার জন্যেই চাঁদ এই রঙ পরিগ্রহ করেছে! সে ক্ষেত্রেও আরেক বিপত্তি,কারণ,মহাজাগতিক বস্তুগুলো নিজে নিজে ভেবে চিন্তে নিজের রঙ গ্রহন করতে পারেনা। কারণ চিন্তাভাবনা করার মত মেধা তাদের নেই। আরেকটা হতে পারে কাকতালীয়ভাবে ব্যবস্থাটা তৈরী হয়ে গেছে। বিষয়টা যে একেবারে অস্বাভাবিক তা কিন্তু নয়! প্রকৃতিতে এমন অস্বাভাবিক ঘটনা হর হামেসাই ঘটে থাকে। পৃথিবীর তাবৎ অবিশ্বাশীরা এমনটাই দাবী করে থাকে; আর তাদের দাবীর মুখে আমরাও যদি এই ধরে নেই যে, একটা বিষয় নাহয় কাকতালীয়ই ভেবে নিলাম-কিন্তু সব বিষয়কেইতো আর কাকতালীয় বলা যাবেনা। আমরা একে একে দেখবো চাদ মহাকাশে এইনই এক বিষ্ময়কর অবস্থানে অবস্থিত যে দৈবাৎ বলার কোন সুযোগই থাকবেনা।
আমরা ‘চাঁদের কক্ষ অনুপমতা’ প্রবন্ধে দেছি, চাঁদ পৃথিবীর এমনই এক বন্ধু যে,তার জন্ম না হলে এই ধরিত্রী তার কোন প্রাণময় সন্তানের জন্ম দিতে পারতোনা। পৃথিবীর মানুষ প্রাচীনকাল থেকেই জানতো ২৯.৫৩০৫৮৯ এক চন্দ্রমাস হয়, বিশেষ করে আরবীয় মানুষ পুরাকাল থেকেই এই চন্দ্র মাসের হিসেবে তাদের সময় গননা করে। কিন্তু বর্তমান বিজ্ঞান গভীর পর্যোবেক্ষন ও পরিক্ষা নীরিক্ষা করে খুঁজে পেয়েছে, চাঁদ ঠিক ২৭.৩১৫৮২ দিনে পৃথিবীকে একবার প্রদক্ষিণ করে তার পূর্বের অবস্থানে আসে। এই সময়কে বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় ‘সিডারাল পর্যায়’ আর ২৯.৫ দিনকে বলা হয় ‘সিনোডিক পর্যায়’।দুই পর্যায়ে সময়ের এই পার্থক্যের কারনে চাঁদ প্রতি মাসে ২.২৯০০৭ দিন করে তার কক্ষপথে এগিয়ে যাচ্ছে। এভাবে এগিয়ে যেতে যেতে চাঁদ প্রতি চন্দ্র বছরে প্রায় একটি অতিরিক্ত পরিক্রমন সম্পন্ন করে আর এই অগ্রযাত্রায় প্রতি ১৩ বছরে এক চন্দ্র বছর এগিয়ে যায়। এই অগ্রগামী অবস্থা আমাদের দৃষ্টি লভ্য হয়না, কিন্তু আমরা দেখি চাঁদের দশা পরিবর্তন। আর এরূপ ঘটে থাকে চাঁদের কক্ষপথের সুক্ষ গাণিতিক হিসেবের জন্যে। এই অগ্রগামী পথে চাঁদ প্রতি ২৪ ঘন্টায় ১৩ ডিগ্রী করে এগিয়ে যায় আর প্রায় ২৭.৩২ দিনে চাঁদ তার কক্ষ পথের পূর্বের স্থানে ফিরে আসে। এ সময় নব চাঁদের জন্ম হলেও তাকে আমরা দেখতে পাইনা, দেখতে পাই আরও ১৩ ডিগ্রী এগিয়ে গেলে অর্থাৎ পূর্ণ চাদের ১৪ ভাগের একাংশ যখন প্রতিফলন কোণের আওতায় এসে পড়ে,তখন। এইভাবে প্রতিদিন চাঁদের ১৮ ভাগের এক ভাগ করে আলোকিত অংশ বাড়তে বাড়তে ১৮ দিনে পূর্ণতা পেয়ে পূর্ণিমা তিথিতে পৌঁছায়, পরবর্তী ১৪ দিন বিপরীত ভাবে ক্ষয়ের পালা। এই ক্ষয় পূরণ অত্যান্ত গাণিতিক হিসেবে সমন্বিত যার সামান্য হের ফের হলে সম্পূর্ণ প্রকিয়াটাই গোলমেলে হয়ে পড়বে; অথচ শত মত কোটি বছর ধরে একই নিয়মে চলছে চাঁদের এই শোভাযাত্রা।
আমরা জানি, পৃথিবী তার চারিদিকে ঘূর্ণনরত চাঁদকে নিয়ে সূর্যোকে প্রদক্ষিন করছে; এই প্রদক্ষিন কালে সূর্যের আলোয় সর্বদাই চাঁদের অর্ধাংশ আলোকিত হয়ে থাকে। চাঁদের অক্ষগতি থাকায় সেই আলোকিত অংশ ঘুরে ঘুরে পৃথিবীর মত সর্বদাই অর্ধেকে সীমাবদ্ধ থাকে; কিন্তু আমরা প্রতিনিয়ত চাঁদের আলোকিত অর্ধাংশকে দেখতে পাইনা। চাঁদ যেহেতু পৃথিবীকে প্রদক্ষিন করে ফলে পৃথিবী এবং সূর্যের সাথে চাঁদের পরিবর্তনশীল কৌণিক অবস্থানের কারণে আমরা পৃথিবীর বিভিন অঞ্চল থেকে আংশিক চাঁদকে দেখতে পাই; যদিও সবসময় তার অর্ধাংশই আলোকিত থাকে। চাঁদের কক্ষগতির কারণে পৃথিবী থেকে এই দৃশ্য অঞ্চল দিনে দিনে বৃদ্ধি পেতে থাকে। চাঁদের এই দৃশ্য অবস্থাকেই বলা হয় দশা আর তার পরিবর্তনকে বলা হয় দশা পরিবর্তন।
নতুন চাদের যে মুখটি পৃথিবীর দিকে থাকে তাতে সূর্যের আপতিত আলোর পুরো অংশটাই তার বিপরীত দিকে পড়ে, অর্থাৎ চাঁদ তখন পৃথিবী ও সূর্যের সংযোগ লাইনের উপর থাকে, ফলে কোন প্রতিফলিত আলো দেখতে পাইনা, পরবর্তী ২৪ ঘন্টায় চাঁদ প্রায় ১৩ ডিগ্রী পূর্ব দিকে এগিয়ে যায় বলে আমরা তার কিছু অংশ দেখতে পাই এবং ক্রমান্বয়ে তা বাড়তে থাকে ও জন্ম থেকে ১৪ তম দিনে ১৮০ ডিগ্রিী অবস্থান পরিবর্তনের মাধ্যামে পূর্ণ দৃশ্য বা পূর্ণিমার রূপ নেয়,তারপর শুরু হয় একই উপায়ে দশা পরিবর্তনের মাধ্যামে ক্ষয়ের পালা এবং অবশেষে নবচাঁদের জন্ম। নতুন চাঁদ বলতে বুঝায়, যখন চাঁদের আলোকিত অংশ থাকে বিপরীত দিকে, তখন শুধুমাত্র চাঁদের ছায়া দেখা যায়।চাঁদ সুরুজ ও পৃথিবী সেদিন এক লাইনে থাকে,চাঁদ থাকে মাঝে।
সূধী পাঠক একবারও কি ভেবে দেখেছেন আমদের চাঁদের এই বিশেষ বৈশিষ্ট গুলো কোথা হতে এল? হয়তো বলবেন এ প্রকৃতিগত। প্রকৃতিগততো বটেই, তবে প্রকৃতিতে এমন অবস্থা কি সে আপনা আপনি পেয়েছে না কি পৃথিবীর প্রয়োজনে তাকে এ অবস্থা দেওয়া হয়েছে? যদি বলেন আপনা আপনি হয়েছে তাও অস্বীকার করার উপায় নেই কারণ কোনটারই চাক্ষুষ কোন প্রমান নেউ। তবে সম্ভাব্যতার দিকটি বিবেচনা করলে কিন্থু মনে হয়, আপনা আপনি এমন সমন্বয় হতে পারেনা, বিশেষ করে যা প্রাণসৃষ্টির জন্যে এত সহায়ক। এবার হয়তো বলবেন, প্রকৃতিতে এমন ব্যবস্থা হয়েছে বলেই আমাদের এই পৃথিবীতে প্রাণের উণ্মেষ ঘটেছে। আপনাদের এ কথাটাকেও অযৌক্তিক বলা চলেন; কারণ পৃথবীটা বিবর্তনের ধারায় প্রাণ সৃষ্টির জন্যে উপযুক্ত হওয়ার পরেই প্রাণ সৃষ্টি হয়েছে। এখানে একটা বিশেষ প্রতিপাদ্য বিষয় হল এই যে, বিজ্ঞানের জানামতে অদ্যাবদি আমাদের এই মহাকাশে প্রাণময় গ্রহ একটারই পরিচয় জানা গেছে । কিন্তু বিজ্ঞানের প্রক্কলিত হিসেব মতে বহু পৃথিবীর উপস্থিতি বাঞ্চণীয়।আমরা অন্যত্র দেখেছি পৃথিবীতে প্রাণীকুলকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে নানাবিধ প্রাকৃতি কৌশল সুসজ্জিত হয়ে আছে, যেমন বায়ুমণ্ডল, ভেন এলেন বেল্ট ইত্যাদি। এ সকল প্রাকৃতিক ব্যবস্থা দেখলে মনের মধ্যে দন্ধ চলে আসে এই ভেবে যে, প্রাণীর প্রয়োজন বুঝে বুঝে প্রকৃতি আপনাতেই এমন ভাবে সুগঠিত হতে পারেনা যতক্ষণ না কোন সুচিন্তিত প্রভাব সৃষ্টি হয়। আমাদের পৃথিবী ও চাঁদের যে পরিমণ্ডল তার মত হয়তো অনেক স্ঞানেই থাকার সম্ভবনা রয়েছে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করলেও এখন পর্যোন্ত অন্য কোন অঞ্চলে প্রাণের সন্ধান মিলেনি। আমরা চাঁদ নিয়ে আলোচনা করছিলাম, চাঁদের এই সমন্বয় দেখে আজকের বিজ্ঞানীরাও স্তম্বিত হয়ে যাচ্ছে। তারা মনে করছেন যে, চাঁদকে পৃথিবীর প্রয়োজন মত বিশেষ ভাবে তৈরী করা হয়েছে এবং অত্যান্ত সুপরিকল্পনার মধ্য দিয়ে সুনির্দিষ্ট কক্ষপথে স্থাপন করা হয়েছে। আজকের বিজ্ঞান ভাবতে বাধ্য হচ্ছে যে এই স্থাপনা অত্যান্ত সুপরিকল্পিত ও সুচিন্তিত। চাঁদকে এক বিষ্ময়কর ঘূর্ণন গতিতে সমন্বিত করা হয়েছে; এর এই গতি সমকালীন(synchronous rotation); অর্থাৎ চাঁদের অক্ষ পর্যায়কাল ও কক্ষ পর্যায় কাল সমান সময়। চাঁদ যে সময়ে তার অক্ষের উপর একটি ঘূর্ণন সম্পন্ন করে ঠিক সেই সময়ে তার কক্ষ পথেও একটি পূর্ণ পরিক্রমন সম্পন্ন করে ফলে তার একই পিঠ আমরা সবসময় দেখতে পাই; কিন্তু সূর্যালোকে তার উভয়পিঠ সমভাবে আলোকিত হয়। ইতিহাস থেকে জানা যায় চাঁদের অক্ষগতি আগে বেশী ছিল তবে; বর্তমানে তা কমে এলেও তার কক্ষপথ দির্ঘায়িত হয়ে এবং তার কক্ষগতি সম্প্রসারনের মাধ্যামে সমন্বয় একই রয়েছে; আর এটি সম্ভব হয়েছে পৃথিবীর জোঁয়াড় ভাটার বিবর্তনের মাধ্যামে। চাঁদ বিশেষ ভাবে তৈরী অত্যান্ত দূর্বল প্রতিফলক। এর আলবেদো কার্যোকারিতা অত্যান্ত কম। আমরা আগেই জেনেছি চাঁদের পৃষ্ট কৃষ্ণকাল আলকাতরার মত; তাই তার প্রতিফলন ক্ষমতা একেবারেই কম। সূধী পাঠক, একবারও কি ভেবে দেখেছেন কেন এমনটা হয়েছে? ভেবে দেখুন, চাঁদ যদি কৃষ্ণ বর্ণের না হয়ে শুভ্র হত তবে আমদের দশা কি হত? নিশাকলে সূর্যের প্রতিফলিত আলোয় পৃথিবী দিবসের ন্যায় উজ্ঝল হয়ে উঠতো, পৃতিবীর তাপীয় অবস্থা কি হত,ভেবে দেখুন। আরও ভেবে দেখুন, চাঁদের কক্ষ তল যদি পৃথিবীর কক্ষতলের সমান্তরাল হত অর্তাৎ চাদের দশা পরিবর্তন না হত তবে নিশার অন্ধকার ঘুচে যেত আর পৃতিবীর তাপীয় অবস্থা সমন্বয় ভেঙ্গে পড়তো।
উপরের এই আলোচনাটুকু কোন কাল্পনিক গল্প নয় ভাবুকদের পরীক্ষা পর্যোবেক্ষণ যা বিজ্ঞান সম্মত ও বহুল সমাদৃত। বিজ্ঞান আরও বলছে, তুলনামূলক একটা বড় ধরণের উপগ্রহ পৃথিবীর চারিদিকে পরিক্রমনের জন্য একটা জটীল হিসেবের মধে স্থাপিত হয়েছে। পৃথিবীর পরিমণ্ডলে ঠিক কত ভরের চাঁদ হলে পৃথিবীতে জীবন উন্মেষের পরিবেশ হতে পারে তা একটা জটীল হিসেব। বিজ্ঞান বলছে কোন না কোন উপায়ে এই হিসেব সাধিত হয়েই চাঁদের জন্ম হয়েছে, সে কোন দূঘর্টনার মধ্যদিয়েই হোক আর আপনা আপনিই হোক। হিসেব ছাড়া এমন সুবিন্যস্ত বিধান হতে পারেনা। আর যদি মেনে নেওয়া হয় যে চন্দ্রের এই সুবিণ্যস্থ অবস্থান কোন দূর্ঘটনা থেকে হিসেব বিহীন ভাবেই হয়েছে তাহলে বলতে হবে পৃথিবীতে জীবনও আপনা আপনিই হয়েছে অথবা কোনেএক স্রষ্টা খুঁজতে খুঁজতে একটা সুন্দর পরিবেশ পেয়ে জীবনের উণ্মেষ ঘটিয়েছেন। তবে একটা কথা থেকে যায়; তা হল, যে স্রষ্টা প্রাণ সৃষ্টি করার মত কুশলী,অবশ্যই সেই স্রষ্টার পক্ষে দূর্ঘটনার সময় প্রয়োজনীয় একটা হসেব সেটে দেওয়া এমন কোন কঠিণ কাজ নয়। আর যদি তেমনাটা হয়েই থাকে তবে আর কোন বিরোধ নেই ; তা, চাঁদ দূর্ঘটনা থেকেই জন্মাক বা আপনা আপনিই সৃষ্টি হয়ে থাক! আমাদের স্বীকার্যো হল ‘চাঁদকে সুনির্দিষ্ট হিসেবের মধ্যে অবস্থান দেওয়া হয়েছে যাতে পৃথিবীর বুকে জীবন সৃষ্টি সহজ হয়। আধুনিক বৈজ্ঞানীক পরীক্ষা নীরিক্ষা অনেকটা সে রকমই বলছে। বিজ্ঞান বলছে বহু বছরে বিভিন্ন সমন্বয়তার মধ্য দিয়েই পৃথিবী জীবন ধারনের পরিবেশ পেয়েছে। তার জন্যে হয়তো কেটে গেছে কোটি কোটি বছর। হয়তে প্রশ্ন করবেন স্রষ্টাকে কেন এত বছরের জন্যে অপেক্ষা করতে হবে: হা সূধী পাঠক,আপনার কৌতুহল অত্যান্ত স্বাভাবিক; তবে আমরা সময়ের আপেক্ষিকতায় দেখেছি,এই কোটী কোটী বছরের পরিসর স্রষ্টার জন্যে নয়। আমরা তার সঠিক পরিসংখ্যান না জানলেও মিহাবিশ্বের বয়স ১৫ শত কোটি বছর এবং তা আমাদের হিসেবে; আর এই পনের শত কোটি বছর যে ভিন্ন কোন অবস্থান থেকে হিসেব করলে মাত্র কয়েক দিন হতে পারে তা কিন্তু বিজ্ঞান নিঃসঙ্কোচে মেনে নিচ্ছে।
মহাকাশীয় বস্তনিলয় সৃষ্টির পর তার অবস্থানের সাথে জড়িয়ে থাকে এক জটীল মহাকর্ষীয় হিসেব; যেমন, তার বস্তুভর, যা চারিদিকের মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের প্রভাবে উৎপন্ন লব্দিবলই নিরূপণ করে মহাকাশের কোন স্থানে তার অবস্থান হতে পারে। এমনি করে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র হিসেবের মধ্য দিয়ে সমন্বিত হয়েই চাঁদ তার নিজ্স্ব অবস্থানে অবস্থান নিয়েছে। বিভিন্ন ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে নানাবিধ ভ্রান্ত ধারনা নিয়ে আলোচনা করবোনা, তবে পবিত্র কোরআনের সূরা ইয়াসিনের ৩৯ নং আয়াতে বর্ণীত হয়েছে চাঁদের গানিতিক ব্যবস্থাপনার কথা।
وَالْقَمَرَ قَدَّرْنَاهُ مَنَازِلَ حَتَّى عَادَ كَالْعُرْجُونِ الْقَدِيمِ
36:39 চন্দ্রের জন্যে আমি বিভিন্ন মনযিল নির্ধারিত করেছি। অবশেষে সে পুরাতন খর্জুর শাখার অনুরূপ হয়ে যায়।
أَلَمْ تَرَوْا كَيْفَ خَلَقَ اللَّهُ سَبْعَ سَمَاوَاتٍ طِبَاقًا
৭১:১৫ তোমরা কি লক্ষ্য কর না যে, আল্লাহ কিভাবে সপ্ত আকাশ স্তরে স্তরে সৃষ্টি করেছেন।
وَجَعَلَ الْقَمَرَ فِيهِنَّ نُورًا وَجَعَلَ الشَّمْسَ سِرَاجًا
৭১:১৬ এবং সেখানে চন্দ্রকে রেখেছেন আলোরূপে এবং সূর্যকে রেখেছেন প্রদীপরূপে।
উপরে বর্ণিত আয়াত দু’টি অবশ্যই বৈজ্ঞানীক তথ্যপূর্ণ আয়াত।
এখানে ৭১:১৬ আয়াতে মহান আল্লাহ দু’টি উল্লেখযোগ্য শব্দ ব্যবহার করেছেন, তিঁনি ‘নূর’ শব্দটি দিয়ে চাঁদকে বুঝিয়েছেন যার অর্থ ‘আলো’; আবার ‘সিরাজ’ শব্দটি দিয়ে সূর্যোকে বুঝিয়েছেন, যার অর্থ প্রদীপ বা আলোক উৎস।
সূধী পাঠক,উল্লিখিত শব্দ দু’টি নিয়ে বিজ্ঞান মনস্ক কিছু তার্কিক বন্ধু পড়েছেন মহা বিপাকে। তারা বলছেন এই নুর শব্দ দিয়ে যদি মহান আল্লাহ আলো বুঝিয়ে থাকেন তথাপিও তা যে সূর্যের প্রতিফলিত আলো বুঝায়না; তাকে আলোকময় বস্তুই বুঝায়।
উইলিয়াম এফ ক্যামবেল এম ডি (William F. Campbell M.D.) দাবী করেছেন যে,যীশু খ্রীষ্টের জন্মের বহু পূর্বে (384-322 B.C) দার্শনিক এরিষ্টোটল বলেছেন যে, চন্দ্রগ্রহনের সময় চাঁদের উপর পৃথিবীর যে ছায়া পড়ে তার আকৃতি গোলাকার; বস্তুটি গোল না হলে তার ছায়া গোলাকার হতে পারেনা। কেম্পবেল সাহেব বলছেন, যে এরিষ্টোটলের এই কথা থেকে বুঝা যায় যে, তিনিও ধারনা করতে পেরেছিলেন যে, চাদের আলো প্রতিফলিত আলো।এরিষ্টোটলের কথা থেকে কি বাস্তবিক এধারণা করা যায়? পৃতিবীর গোলকত্বের ধারণা কি চাঁদকে প্রতিফলক হিসেবে প্রমান করে। সূর্যেরও গ্রহন হয়, তাতে চাঁদের গলকত্বের প্রমাণ হতে পারে কিন্তু তা চাঁদকে প্রতিফলক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেনা। এটি নিতান্তই ক্যাম্পবেল সাহেবের অনুমান। তিনি আরও প্রশ্ন করেছেন, চাঁদকে বুঝাতে কেন ‘আলো’ আর সুরুজ কে বুঝাতে ‘প্রদীপ’ এই দু’টি আলাদা নাম শব্দ ব্যবহার করা হল? কেনইবা আল্লাহ পরিস্কার করে বললেননা যে, চাঁদের আলো সূর্যের আলোর প্রতিফলন? তিনি মন্তব্য করেছেন যে, আমরা যদি কোরআনের এই উক্তিকে বৈজ্ঞানীক বিষ্ময় বলে দাবী করি তবে অবশ্যই তার ভাষাগত বর্ণনা ও সঠিকতা বৈজ্ঞানীক পরিমাপে হতে হবে।
সূধী পাঠক অতীব সুন্দর দাবী! এখানে একটি কথা বিশেষভাবে জ্ঞাতব্য যে, পবিত্র কোরআন কোন বিজ্ঞান পুস্তিকা নয়, মহান আল্লাহ নিজে বৈজ্ঞানীক নয়, তিনি নিউটন, আইষ্টাইন বা স্টিফেন হকিন্সের নীতি প্রনয়ন করেননি যে, তিঁনি তাদের নিয়ম নীতি অনুযায়ী ব্যাখ্যা দেবেন। তিঁনি তার নিজস্ব নিয়মে এই মহাবিশ্বকে সৃষ্টি করেছে, তার মধ্যে কিছু নিয়ম সেঁটে দিয়েছেন, যে নিয়মে আমাদের মহাবিশ্ব সচল,কিন্তু তিনি সেই নিয়মের অধীন নয়; তাই মাঝে মাঝে প্রকৃতির নিয়মের মাঝেও অনিয়ম চোখে পড়ে। তিঁনি পবিত্র কোরআনে কিছু বিষ্ময়কর ইঙ্গিত দান করেছেন,সে গুলোর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের জন্যে তিঁনি ভাবুক সম্প্রদায়কে আহ্বান করেছেন,যারা ভেবেচিন্তে তাদের নিজস্ব নিয়মে ব্যাখ্যা দান করবে,যা হবে প্রকৃতির নিয়ম। আরেকটা বিষয় ভেবে অবাক না হয়ে পারিনা এই ভেবে যে , বিজ্ঞ বন্দুরা এত কষ্ট করে কোরআনের কথিত দাবী ‘চাঁদের আলো সূর্যালোকের প্রতিফলন’ কে ভুল প্রমান করার জন্যে এত কষ্ট করে প্রবন্ধ রচনা করছেন কেন! পবিত্র কোরআন কি কোথাও এমনটা দাবী করেছে? পবিত্র কোরআন শুধু একটা সংবাদ পরিবেশন করেছে যে, সূর্যো প্রদীপ তূল্য আলোর উৎস আর চাঁদ তেমনটা নয়, আমরা একে আলো রূপে দেখতে পাই; মোটকথা এটি আলোর উৎস নয়। চাঁদের আলো কোথা থেকে আসে,একি সূর্যের আলোর প্রতিফলন, না কি পৃথিবী থেকে প্রতিফলিত আলো গিয়ে তার উপর পড়ে, এর কোনটা নিয়েই কোরআন আলোচনা করেনি আবার এমনও বলেনি যে চাঁদ আলো দিয়ে তৈরী। ১৪০০ বছর আগে কোরআন এ সংবাদটি দিয়েছে ভাবুকদের জন্যে। বিষ্ময়ের যদি কিছু থেকে থাকে তবে এখানেই তা লুকিয়ে আছে, ‘একটা আলোকময় বস্তু যে আলোর উৎস নয়’ এই সংবাদটি শতভাগ সঠিকথায় পরিবেশন করা কি বিষ্ময়ের কথা নয়।আসলে দূর্ভাগ্য আমাদের! বিজ্ঞান যেই বলল, চাঁদের আলো তার নিজের নয়, সূর্যের আলোর প্রতিফলন আর অমনি আমরা আনন্দে নেচে উঠে বললাম,এইতো পবিত্র কোরআনেও লেখা আছে সেই কথা। আর অমনি শুরু হল দু’দলের টানাটানি।
সূধী পাঠক, বিজ্ঞান সত্যের সাধক, সে তার ভাবনার জগতে যা কিছু ভাবছে,তা যখন শতভাগ সঠিকতায় সত্যের বিচারে নীরেট প্রমানিত হবে তখনই তা বিজ্ঞান হয়ে মানুষের কাছে প্রতিভাত হবে, কোন বিজ্ঞানীর ভাবনা চিন্তা গুলোই বিজ্ঞান নয়। বিজ্ঞান মহান আল্লাহর সৃষ্ট নিয়ম নীতির মাঝে তার ভাবনাগুলোকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে; সেখানে কোন ধর্মীয় বাণী যদি সহায়ক ভূমিকা পালন করে তবে তাতে প্রতিদ্ধীতার কিছু আছে বলে আমরা মনে করিনা। মহান আল্লাহ তার বাণী গুলোর সত্যতা প্রমানের কোন দ্বায়িত্ব বিজ্ঞানকে দেননি। তিঁনি শুধু কিছু ধারণা দিয়েছেন আর ভাবুকদেরকে তা ভেবে দেখার জন্যে আহ্বান করেছেন। বাণীর সত্যতা প্রমাণের দ্বায়িত্ব তাঁর নিজের। তবে বিজ্ঞানীদের ভাবনা চিন্তায় নীরেট সত্য যা বেড়িয়ে আসবে সেটুকুই হবে তাঁর চাওয়া। বিজ্ঞান যদি সঠিকভাবে বলে থাকে যে চাঁদের আলো সূর্যালোকের প্রতিফলন তবে কোরআনের সাথেতো তার কোন বিরোধ নেই। কোরআনের বাণীর অলৌকিতা পরিক্ষার মাধ্যামে প্রমাণের অপেক্ষা রাখেনা, অলৌকিকতা তার বর্ণনা শৈলীতেই মিশে আছে।
ক্যাম্পবেল সাহেব ‘মুনির’ ও ‘সিরাজ’ শব্দ দু’টির ব্যবহার নিয়েও বিশদ আলোচনা করেছেন। কোরআনে ৬ বার মুনির শব্দটি ব্যবহৃত হওয়ার মধে ৪ বার ব্যবহৃত হয়েছে ৩:১৮৪, ২২:৮, ৩১;২০ ও ৩৫:৩৫ আয়াতে; এই চারটি আয়াতই পবিত্র কোরআনকে লক্ষ্যকরে শব্দজোড় ‘কিতাব আল মুণির‘ রূপে বসেছে,যার অর্থ আলোবিতরনকারী গ্রন্থ। সূধী পাঠক এখানে লক্ষনীয় যে, এই ৪ ক্ষেত্রে ‘মুনির’ শব্দটির অলঙ্কারিক ব্যবহার হয়েছে। এখানে কোরআনকে আলোর সাথে তুলনা করা হয়েছে বটে কিন্তু আলোকবর্তীকা বা আলোর উৎস বলা হয়নি। কোরআন কোন আলোর প্রতিফলক নয় এটি উপমা স্বরূপ অলঙ্কারিক ব্যবহার, কোন বৈজ্ঞানীক তথ্য পূর্ণ নয়। আলোচনার উল্যেখযোগ্য অংশ হল সূরা আল নুর এর ৩৫ নং আয়াতটি; اللَّهُ نُورُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ مَثَلُ نُورِهِ كَمِشْكَاةٍ فِيهَا مِصْبَاحٌ الْمِصْبَاحُ فِي زُجَاجَةٍ الزُّجَاجَةُ كَأَنَّهَا كَوْكَبٌ دُرِّيٌّ يُوقَدُ مِن شَجَرَةٍ مُّبَارَكَةٍ زَيْتُونِةٍ لَّا شَرْقِيَّةٍ وَلَا غَرْبِيَّةٍ يَكَادُ زَيْتُهَا يُضِيءُ وَلَوْ لَمْ تَمْسَسْهُ نَارٌ نُّورٌ عَلَى نُورٍ يَهْدِي اللَّهُ لِنُورِهِ مَن يَشَاء وَيَضْرِبُ اللَّهُ الْأَمْثَالَ لِلنَّاسِ وَاللَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ
২৪:৩৫ আল্লাহ নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের জ্যোতি, তাঁর জ্যোতির উদাহরণ যেন একটি কুলঙ্গি, যাতে আছে একটি প্রদীপ, প্রদীপটি একটি কাঁচপাত্রে স্থাপিত, কাঁচপাত্রটি উজ্জ্বল নক্ষত্র সদৃশ্য। তাতে পুতঃপবিত্র যয়তুন বৃক্ষের তৈল প্রজ্বলিত হয়, যা পূর্বমুখী নয় এবং পশ্চিমমুখীও নয়। অগ্নি স্পর্শ না করলেও তার তৈল যেন আলোকিত হওয়ার নিকটবর্তী। জ্যোতির উপর জ্যোতি। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পথ দেখান তাঁর জ্যোতির দিকে। আল্লাহ মানুষের জন্যে দৃষ্টান্তসমূহ বর্ণনা করেন এবং আল্লাহ সব বিষয়ে জ্ঞাত।
যেখানে বলা হয়েছে ‘আল্লাহ নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের আলো’ । পক্ষান্তরে আয়াত ৭১:১৫-১৬, ২৬:৬১ ও ৭৮:১৩ তে ‘সিরাজ’ শব্দটি সূর্যোকে বুঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে, যার অর্থ আলোর উৎস। এ পর্যায়ে এসে ক্যাম্পবেল সাহেব ২৪:৩৫ আয়াতের উদাহরণ টেনে প্রশ্ন রেখেছেন ‘মহান আল্লাহ কেন নিজেকে আলোর উৎস (সিরাজ) না বলে আলো (নেুর) হিসেবে বরণনা করেছেন? তিনি আরও উদহরণ টেনেছেন আয়াত ৩৩:৪৫-৪৬ এর যেখানে নবী মোহাম্মদ (সাঃ) কে আলো বিচ্ছুরণকারী উৎস হিসেবে বর্ণনা করেছেন;
يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ إِنَّا أَرْسَلْنَاكَ شَاهِدًا وَمُبَشِّرًا وَنَذِيرًا
৩৩:৪৫ হে নবী! আমি আপনাকে সাক্ষী, সুসংবাদ দাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেছি।
وَدَاعِيًا إِلَى اللَّهِ بِإِذْنِهِ وَسِرَاجًا مُّنِيرًا
৩৩:৪৬ এবং আল্লাহর আদেশক্রমে তাঁর দিকে আহবায়করূপে এবং উজ্জ্বল প্রদীপরূপে।
এ ক্ষেত্রে তিনি দুঃখ করে বুঝাতে চেয়েছেন যে মোহাম্মদ (সাঃ) কে আলোক বর্তীকা ও নিজেকে আলোর প্রতিফলক হিসেবে বর্ণনা করে আল্লাহ ভুল শব্দ প্রয়োগ করেছেন।
সূধী পাঠক,ক্যাম্পবেল সাহেবের এই উক্তিতে যে খুব বিজ্ঞতার পরিচয় ফুঁটে উঠে তা কিন্তু নয়। আমরা আগেই বলেছি, মহান আল্লাহ আমাদের বিজ্ঞানীদের মত কোন বিজ্ঞানী নয়, তিনি মানব অভিধা সম্পন্ন কোন প্রণীও নয়; ফলে কোরআনে শাব্দিক ব্যবহারও অত্যান্ত বিজ্ঞতা পূর্ন। যদি তিঁনি নিজেকে আলোক বর্তীকা (যা আমাদের কাম্য) রূপে এবং নবীকে প্রতিফলক রূপে বর্ণনা করতেন তবে আমরা কি ধরে নিতাম? ধরে নিতাম স্বয়ং আল্লাহ নুরের তৈরী। তাঁর সৃষ্টিগত রূপরেখা আমাদের কাছে চলে আসতো। আমাদের কল্পনায় তাঁর দক্ষতা ও ক্ষমতার একটা কাল্পনিক পরিমণ্ডল সৃষ্টি হত (নাউযুবিল্লাহ)। আমরা জানি তিনি এ সকল ধারনার উর্ধে। তাঁর সৃষ্টি বৈশিষ্ট সম্পর্কে আমরা অজ্ঞ। মহান আল্লাহর শব্দ চয়ন একেবারেই নিখুঁত। এখানে দুঃখ করারতো কিছু নেই বরং এ বর্ণনা বিষ্ময়কর। এখানে নবীকে আল্লাহর নির্দেশনাবলীর উৎস রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। সূরা আল আহযাবের (৩৩:৪৬) এই আয়াতটিতে শব্দজোড় ব্যবহারটি কত বিষ্ময়কর, অর্থাৎ ‘পদীপের আলো রূপে’ ঠিক প্রদীপ রূপে নয় বর্ণনা করা হয়েছে অথচ ভিন্ন আয়াতে সর্যোকে প্রদীপ (সিরাজ) বলা হয়েছে।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours