জগতে কিছু মানুষ থাকেন, মৃত্যুর পর তাঁরা যেন সবার হৃদয়ে আরও বেশি ভালোবাসায় জড়িয়ে থাকেন। তাঁদের কোনো মৃত্যু হয় না। মানুষের মনে চিরকাল অমর হয়েই থাকেন তাঁরা। সেলিব্রেটিদের ক্ষেত্রে এ ব্যাপারটি বেশি ঘটে। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে তেমনই একজন অভিনেতা মান্না। টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে জন্ম নেওয়া এই নায়কের আসল নাম এস এম আসলাম তালুকদার। ছোটবেলা থেকে সিনেমার প্রতি তাঁর ছিল প্রচণ্ড ঝোঁক। কলেজে পড়ার সময় প্রচুর সিনেমা দেখতেন। নায়ক রাজ্জাকের সিনেমা হলে তো কথাই নেই। স্বপ্ন দেখতেন তিনিও একদিন অভিনয় করবেন। অনেকের ইচ্ছে থাকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার; কিন্তু তাঁর ইচ্ছে ছিল নায়ক হওয়ার। একদিন বলাকায় সিনেমা দেখতে গিয়ে চোখে পড়ে ‘নতুন মুখের সন্ধানে’ বিজ্ঞাপন। তারপর টিভি আর পত্রিকায় দেখে বন্ধুদের সঙ্গে পরামর্শ করে তিনি ইন্টারভিউ দেন। সুযোগও পেয়ে যান।

পরিচয়

মান্না নামেই অধিক পরিচিত সৈয়দ মোহাম্মদ আসলাম তালুকদার । 
১৯৬৪ সালে ৬ ডিসেম্বর টাঙ্গাইলের কালিহাতিতে জন্ম গ্রহণ করেন বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তী নায়ক মান্না।তার স্ত্রীর নাম েশেলী মান্না ্এবং তার একমাত্র ছেলের নাম সিয়াম 

প্রারম্ভিক জীবন

১৯৮৪ সালে ‘নতুন মুখের সন্ধানে’ কার্যক্রমের মাধ্যমে চলচ্চিত্র অঙ্গনে পা রাখেন আসলাম তালুকদার। টাঙ্গাইলের এস এম আসলাম তালুকদার নামের সেই কিশোর হয়তো তখনো জানতেন না যে তিনিই একদিন হয়ে উঠবেন ঢাকাই চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় নায়ক।
চিত্রনায়ক মান্না (১৯৮৪)

শুধু তা-ই নয়, ঢাকাই চলচ্চিত্রের একজন নির্ভরযোগ্য নায়ক হবেন তিনি। ‘নতুন মুখের সন্ধানে’ কার্যক্রমে সুযোগ পেয়েই কিন্তু আসলাম থেকে নায়ক মান্না হতে পারেননি তিনি। এর জন্য অনেক ত্যাগ, অনেক কষ্ট স্বীকার করতে হয়েছে তাঁকে। এফডিসির অফিস পাড়ায় ঘোরাঘুরি আর নিয়মিত পরিচালকদের কাছে ধরনা দিতে হতো। যে রাজ্জাককে দেখে চলচ্চিত্রে অভিনয়ের স্বপ্ন দেখার শুরু, সেই রাজ্জাকই এক সময় তাঁকে সুযোগ করে দেন চলচ্চিত্রে অভিনয়ের।

কর্মপরিধি

১৯৮৬ সালে ‘নায়করাজ’ রাজ্জাকের এক বন্ধুর প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান থেকে নির্মিত ‘তওবা’ সিনেমায় অভিনয়ের সুযোগ ঘটে মান্নার। আর এভাবেই শুরু হয় নায়ক মান্নার চলচ্চিত্র জীবনের যাত্রা। চলচ্চিত্রের প্রয়োজনে এস এম আসলাম তালুকদার নাম বদলিয়ে হয়ে ওঠেন মান্না। শুরুতে একের পর এক অ্যান্টি হিরো হিসেবে অভিনয় করেছেন। কিন্তু সে সময় তেমন কোনো সাফল্য আনতে পারেননি।
আশির দশকে মান্না যখন ছবিতে অভিনয় শুরু করেন, সে সময় রাজ্জাক, আলমগীর, জসীম, ফারুক, জাফর ইকবাল, ইলিয়াস কাঞ্চনের নায়ক হিসেবে বেশ দাপট। সেই দাপুটে অভিনেতাদের মাঝেও ‘তওবা’, ‘পাগলী’, ‘ছেলে কার’, ‘নিষ্পাপ’, ‘পালকি’, ‘দুঃখিনী মা’, ‘বাদশা ভাই’-এর মতো ব্যবসাসফল ছবি উপহার দিয়েছেন মান্না। দুঃখজনক হচ্ছে, এসব ছবির কোনোটিতেই মান্না প্রধান নায়ক ছিলেন না। তাই সাফল্যের ভাগীদার খুব একটা হতে পারতেন না।
মান্না অভিনীত প্রথম ছবি ‘তওবা’ হলেও প্রথম ছবি হিসেবে যে ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল তার নাম ‘পাগলী’। ১৯৯১ সালে মোস্তফা আনোয়ার পরিচালিত ‘কাশেম মালার প্রেম’ ছবিতে প্রথম একক নায়ক হিসেবে সুযোগ পেয়েছিলেন মান্না। এ ছবিটি সুপার-ডুপার হিট হওয়ার কারণে একের পর এক একক ছবিতে কাজ করার সুযোগ পান মান্না। এরপর কাজী হায়াতের ‘দাঙ্গা’ ও ‘ত্রাস’ ছবির কারণে তাঁর একক নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়া সহজ হয়ে যায়। এরপর আরও কয়েকটি ব্যবসাসফল ছবি উপহার দেন মান্না। দেলোয়ার জাহান ঝন্টুর ‘গরীবের বন্ধু’ ছবির পর একটু ধীরে এগোতে থাকেন মান্না। সে সময় মান্নাকে নিয়ে সবার আগ্রহ তৈরি হয়। সবাই তাঁকে নিয়ে ছবি বানাতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। চলচ্চিত্রের প্রযোজক-পরিচালকেরাও তাঁর কাছে নির্ভরতা খুঁজে পান।
মান্না পুত্র সিয়াম
নব্বইয়ের দশকের শুরুতে নাঈম-শাবনাজ, সালমান-শাবনূর, সানী-মৌসুমি জুটি বেশ সফল। তাঁদের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে যান মান্না।
মমতাজুর রহমান আকবর, কাজী হায়াত, নুর হোসেন বলাই, নাদিম মাহমুদ, এম এ মালেক, এফ আই মানিক, মোস্তাফিজুর রহমান বাবু, এ জে রানা, বেলাল আহমেদের মতো পরিচালকের ছবি দিয়ে মান্না নিজেকে প্রমাণ করতে থাকেন। পরিচালকেরা তাঁর প্রতি আস্থা অর্জন করতে শুরু করেন। ১৯৯৬ সালে সালমান শাহের হঠাৎ মৃত্যুতে প্রযোজক-পরিচালকেরা দিশেহারা হয়ে যান। কারণ সে সময় সালমান শাহের ওপর বিনিয়োগ ছিল অনেক বেশি। এ সময়ে পরিচালকদের চোখে একমাত্র আস্থার নায়ক হিসেবে ধরা দেন মান্না। মান্নাও পুরো চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিকে নিজের কাঁধে তুলে নেওয়ার মতো কঠিন দায়িত্বটি নিষ্ঠার সঙ্গেই পালন করেন। ১৯৯৭ সালে নায়ক থেকে প্রযোজনায়ও আসেন মান্না। মান্নার প্রথম ছবি ‘লুটতরাজ’ সুপারহিট ব্যবসা করে। এরপর বাংলাদেশি চলচ্চিত্রে শুরু হয় মান্না-অধ্যায়। একের পর এক মুক্তি পেতে থাকে মান্না অভিনীত বেশ কয়েকটি ছবি। বেশির ভাগ ছবিই দর্শকপ্রিয়তা পাওয়ার পাশাপাশি ব্যবসায়িক সফলতাও পায়। সবাই মান্নাকে নিয়ে একের পর এক ছবি বানাতে থাকেন। প্রযোজক-পরিচালকরা তাঁর মধ্যে খুঁজে পান নতুন আশার আলো।
চলচ্চিত্রে অভিনয়ের পাশাপাশি চলচ্চিত্র-বিষয়ক নানা কর্মকাণ্ডেও মান্নার ছিল অগ্রণী ভূমিকা। বাংলাদেশি চলচ্চিত্রে হঠাৎ অশ্লীলতা জেঁকে বসলে হাল ধরেন মান্না। বাংলা চলচ্চিত্রের অন্ধকার কাটতে থাকে তাঁর দৃঢ় ভূমিকার কারণে। সে সময় একমাত্র নায়ক মান্নার ছবিগুলোই ছিল প্রযোজক ও পরিচালকদের আশার আলো, ব্যবসায় টিকে থাকার সাহস। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মান্না একাই লড়ে গেছেন।
নায়ক মান্নার স্ত্রী শেলী
আশির দশকে সুনেত্রা, নিপা মোনালিসা থেকে শুরু করে চম্পা, দিতি, রোজিনা, নূতন, অরুণা বিশ্বাস, কবিতার মতো সিনিয়র নায়িকাদের সঙ্গে অভিনয় করে যেমন সফল হয়েছিলেন, তেমনি মৌসুমি, শাবনূর, পূর্ণিমা, মুনমুন, সাথী, স্বাগতা, শিল্পী, লিমাদের সঙ্গে তাঁর ছবি ব্যবসায়িক সফলতা পেয়েছে। বাংলাদেশের বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে তাঁর নাম স্মরণীয় হয়ে থাকবে। অভিনয়, সংলাপ বলার ধরন দিয়ে নিজস্ব একটা স্টাইল দাঁড় করিয়েছিলেন তিনি। তাঁর অভিনীত এমন কিছু ছবি আছে যার জন্য তিনি চিরদিনের জন্য দর্শকের মনে জায়গা করে নিয়েছেন। একটা সময় ছিল, যখন ছবিতে শুধু মান্না আছেন‍- এ কারণেই দর্শক হলে ছুটে গেছেন, তাঁর কারণেই ছবি ব্যবসাসফল হয়েছে। মান্না যে ছবিতে দুর্দান্ত, সেই ছবির কাহিনি যত গতানুগতিকই হোক না কেন, সেই ছবি ব্যবসা করবেই তাতে কোনো সন্দেহ নেই। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটনির্ভর ছবিতেও মান্না ছিলেন অনবদ্য।

মৃত্যু

২০০৮ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৪৪ বছর বয়সে নায়ক মান্না মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পর তার জানাজা এফডিসিতে হয়। ২য় জানাজা স্মৃতিসৌধে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দর্শকদের ভালবাসা এবং শ্রদ্ধা কারনে ভক্তকুলের ভিড় এড়িয়ে, ও ঢাকার অত্যাধিক ট্রাফিক জ্যাম ঠেলে সেখানে নেয়া সম্ভব হয়নি।টাঙ্গাইল জেলায় অবস্থিত তার নিজ গ্রাম এলেঙ্গায় এই মহান নায়ককে সমাহিত করা হয়।

সম্মাননা

জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার 
* শ্রেষ্ঠ অভিনেতা - বীর সৈনিক (২০০৩)
বাচসাস পুরস্কার 
* শ্রেষ্ঠ অভিনেতা - আম্মাজান
মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার 
* শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র অভিনেতা - ১৯৯৯, ২০০৭

সূত্র : বিভিন্ন ব্লগ থেকে সংগৃহিত ও সম্পাদিত
Share To:

Naim Khan

Post A Comment:

0 comments so far,add yours