আজকের আধুনিক সভ্যতা যুগ যুগান্তরের নিরন্তর প্রচেষ্টার ফল কেননা কোন সভ্যতাই শুরুতে পরিপূর্ণ ছিল না ।বিবর্তনেই কেবল তা পরিপূর্ণতা পেয়েছেকাল কে পিছনে ফেলে কিছু কিছু সভ্যতা আমাদেরকে তার শ্রেষ্ঠত্ব চিনিয়েছে যা আজও আমাদের মনে দাগ কেটে যায় এমনই এক সভ্যতা প্রাচীন রোম আজকে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি প্রাচীন রোম সাম্রাজ্য নিয়ে তরে ভারি ভারি কোন ত্বত্ত্ব কথাতে যাব না, বলব প্রাচীন সেই সোনালী যুগের অন্ধকার দিকটার কথা প্রদীপের তলাতেই থাকে অন্ধকার তেমনি সে সময়েও কালো ছায়া কম ছিল না উন্নতির তালে তালে সেখানে বাসা বাঁধে ভয়ংকর সব অপরাধ কিন্তু কেমন ছিল প্রাচীন রোমের সেই অপরাধ জগৎ!! চলুন জেনে নেই-
প্রাচীন রোম পৃথিবীর সমৃদ্ধতম প্রাচীন সভ্যতাগুলোর মধ্যে অন্যতম যা খ্রিষ্টপূর্ব ৮ম শতাব্দীর প্রথমভাগে ইতালীয় উপদ্বীপে সূচীত হয় রোমশহরকে কেন্দ্র করে ভূমধ্যসাগরের তীর ধরে এই সভ্যতা বিকাশিত হতে থাকে, এবং কালক্রমে একটি প্রাচীন যুগের বৃহত্তম সাম্রাজ্যে পরিণত হয়
এই সভ্যতার স্থায়ীত্বকাল ছিল প্রায় বারো শতক এবং দীর্ঘ সময়ের পরিক্রমায় রোমান সভ্যতা একটি রাজতন্ত্র থেকে একটি সম্ভ্রান্ত প্রজাতন্ত্র এবং পর্যায়ক্রমে একটি একনায়কতন্ত্রী সাম্রাজ্যে পরিবর্তিত হয় রোম ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের সবচেয়ে প্রভাবশালী সাম্রাজ্য এবং প্রাচীন বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী সাম্রাজ্যগুলোর একটি ছিল


প্রাচীন রোমের মাথাব্যথার অন্যতম একটা বড় কারণ ছিল অপরাধ চুরি-ডাকাতি ছিল সাধারণ ব্যাপার, এমনকি দাঙ্গা-ফ্যাসাদও সওদাগররা তাদের ক্রেতাদেরকে প্রতিনিয়ত ঠকাতো, মরিয়া ক্রীতদাসরা নিয়মিত পালিয়ে গিয়ে ভিড়তো অপরাধীদের দলে যারা লুকিয়ে থাকতো রোম শহরের নিচের গোপন কুঠুরিতে সমাজের উচ্চপদে আসীন অভিজাত আর ধনীরা গোপন ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে নিজেদের ক্ষমতা আর সম্পদের পরিমাণটা আরেকটু বাড়িয়ে নিতে চাইতো একদম শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরো শহরই অপরাধীদের চক্করে হয়ে উঠতো কঠিন ধাঁধার মতো
প্রাচীন রোম শহর: অপরাধীদের স্বর্গরাজ্য; Source: Brewminate

সুড়ঙ্গের বাসিন্দা

প্রাচীন রোমের রাজপথের নিচে ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গ আর গুহাগুলো দখল করে রেখেছিলো রোমের অন্ধকার জগতের পান্ডারা এই প্যাঁচানো গোলকধাঁধাগুলো ছিলো পালিয়ে যাওয়া দাস আর অন্য ধর্মে ধর্মান্তরিত অপরাধীদের কেন্দ্রস্থল অন্ধকার, স্যাঁতস্যাঁতে, পোকামাকড়ে ভরপুর আর আগের বাসিন্দাদের লাশ আর কঙ্কালে ছড়িয়ে থাকা সুড়ঙ্গগুলো এমন কোনো জায়গা নয় যেখানে লোকজন থাকতে চাইতো পালিয়ে যাওয়া ক্রীতদাসরা প্রথম সুযোগেই এখান থেকে সটকে পড়তে চাইতো, তবে এর কারণ শুধুমাত্র এর বিষণ্ণময় পরিবেশ নয় খ্রিস্টপূর্ব ৭১ অব্দে স্পার্টাকাস নামের এক গ্ল্যাডিয়েটরকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে দেয় রোমানরা এই গ্ল্যাডিয়েটর পালিয়ে যাওয়া ক্রীতদাসদেরকে একত্রিত করে রোম দখলের জন্য উঠেপড়ে লেগেছিলেন প্রায় দুইবছর ধরে চলা তৃতীয় সেভিল যুদ্ধে রোমের জন্য বেশ বড় বিপদ হিসেবেই আবির্ভূত হয়েছিলেন এই রোমান গ্ল্যাডিয়েটর তারপর থেকেই পালিয়ে যাওয়া ক্রীতদাসদের তাদের অপরাধের শাস্তি বাড়িয়ে দেওয়া হয় কয়েকগুণ ধরা পড়ার হাত থেকে বাঁচতে তাই চোখমুখ বুজেই সুড়ঙ্গের অসহ্য পরিবেশ সহ্য করে নিতে হতো পলাতকদেরকে, আর প্রথম সুযোগেই চলে যেতো রোমের জাঁকজমকপূর্ণ
স্পার্টাকাস: পলাতক ক্রীতদাসদেরকে নিয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করা গ্ল্যাডিয়েটর; Source: Ancient Origins
গোলকধাঁধা রুপ এই সুড়ঙ্গের একমাত্র স্থায়ী বাসিন্দা ছিলো ধর্মান্তরিত ব্যক্তিরা রোমানরা সাধারণত অন্য ধর্মের দেবতাদের উপরও বেশ উদারমনা ছিলো, তিনটি ধর্ম ছাড়া- ইহুদী, খ্রিস্টান আর বাক্কানালিয়া রোমানদের ভাষায় এই তিন ধর্মানুসারীরা রোমান ধর্মের জন্য হুমকি বাক্কানালিয়া ধর্ম রোমানরা আয়ত্ত করেছিলো গ্রিকদের কাছ থেকে এই ধর্মের অনুসারীরা প্রধান দেবতা বাক্কাসের পূজা করতো অদ্ভুত পদ্ধতিতে মাতাল হয়ে খোলামেলা জায়গাতেই একত্র হয়ে তারা যৌনমিলনে অংশগ্রহণ করতো এবং এই গুজবও শোনা যায়, এই কাজ করতে কেউ অস্বীকৃতি জানালে তাকে খুন করতেও দ্বিধাবোধ করতো না বাক্কানালীয়রা খ্রিষ্টপূর্ব ১৮৬ অব্দে বাক্কানালীয়দের বিরুদ্ধে বিশেষ আইন তৈরি করা হয়, যার ফলে তাদেরকে আশ্রয় নিতে হয় সুড়ঙ্গের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে
অন্যদিকে ইহুদী আর খ্রিস্টানদেরকে অপরাধী হিসেবে গণ্য করা হতো, কারণ তারা বিশ্বাস করতো মাত্র একজন দেবতারই অস্তিত্ব রয়েছে। রোমান রিপাবলিক আমলেও এই দুই ধর্মের অনুসারীদেরকে খুব একটা খারাপ চোখে দেখা হতো না। কিন্তু রোম যখন সাম্রাজ্যে রুপ নিলো, এই দুই ধর্মের ব্যক্তিরা বেশ বড় হুমকি হয়ে দেখা দিলো। রোমের শেষ স্বৈরশাসক জুলিয়াস সিজার (ল্যাটিন উচ্চারণ ইউলিয়াস কাইসার)-এর মৃত্যুর পর রোমানরা তাকে দেবতা হিসেবে সম্মান দেখিয়েছিল। তার মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার অগাস্টাস নিজের উপাধি হিসেবে গ্রহণ করেনDivi Filius’, যার অর্থদেবতার সন্তান ইহুদী আর খ্রিস্টানরা এই উপাধিকে অস্বীকৃতি জানানোর পর তাদের বিরুদ্ধে কঠিন শাস্তির আদেশ দেওয়া হয়। শেষমেশ তাদেরও শেষ ঠিকানা হয় অন্ধকার সুড়ঙ্গ

প্রাচীন রোমের ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গ; Source: ItaloAmericano
রোমের এসব সুড়ঙ্গে তাদের থাকার প্রমাণ পাওয়া যায় খুব ভালোমতোই। প্রায়ই তারা তাদের নিজেদের ধর্মীয় চিহ্নগুলো দেওয়ালে এঁকে রাখতো। ইহুদীরা নিজেদের ধর্মীয় প্রথাগুলোর ছবি এঁকে রাখতো, কিংবা মেনোরাহ– সাত শাখার এই মোমবাতিদানকে ধরা হয় ইহুদীবাদের অন্যতম প্রধান প্রতীক। খ্রিস্টানরা আবার এদিক দিয়ে সামান্য ভিন্ন ছিলো। তারা জানতো, তারাই রোমের সবচেয়ে ঘৃণিত ধর্মানুসারী এবং তাদেরকে ধরতে মাঝেমধ্যে রোমের পুলিশরা সুড়ঙ্গগুলোতেও ঢুঁ মারতো, তাই তারা প্রথাগত ক্রুশের বদলে কাই-রো কিংবা অন্যান্য চিহ্ন ব্যবহার করতো, যা খ্রিস্টধর্মের প্রার্থনার গোপন কোড হিসেবে এখনো ব্যবহৃত হয়। এই চিহ্নগুলো অন্যান্য অপরাধীদেরকে দেখিয়ে দিতো অন্ধকার গোলকধাঁধার কোন পথে যেতে হবে। ইহুদী আর খ্রিস্টানরা অন্যান্যদের মতো পালিয়ে যেত না তার একমাত্র কারণ, তারা বিশ্বাস করতো তাদের কাজ হলো তাদের ধর্মবিশ্বাস রোমানদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া। এবং এর বিনিময়ে পরকালে তাদেরকে পুরস্কৃত করা হবে।
দেয়ালে খোদাই করা ইহুদীদের ‘মেনোরাহ’; Source: Haaretz

ধুলো ওড়া রাস্তা, নকল পণ্য এবং অভিজাত রাজদ্রোহিতা

রোমের রাস্তায় হাঁটার অপর নাম ছিনতাইকারী আর চোরদের সাথে গলায় গলা মিশিয়ে দেওয়া। কোলাহল আর ভিড়ে আকণ্ঠ রোমের রাস্তা পকেটমারদের জন্য ছিল স্বর্গ। আক্রান্ত ব্যক্তি বোঝার আগেই তার বেল্ট থেকে কেটে নেওয়া পার্স চুরি করে ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া খুব কঠিন কোনো কাজ ছিল না। রোমের গরীব বাসিন্দা, যারা রোমান নাগরিক ছিল না, ছিল নিম্নস্তরের ‘প্লেবিয়ান’, তারাই ছিল মূলত রোমের রাস্তার অপরাধী। আধপেটা, ডিনারে সিরকা আর সীমের বিচি খেয়ে কাটানো এই প্লেবিয়ানরা মূলত লোভের জন্য চুরি করতো না, করতো নিজেদের পেট চালানোর জন্য। চুরি করা কয়েকটা মুদ্রা তাদের অভাবকে কিছুক্ষণের জন্য ভুলে থাকার জন্য যথেষ্ট ছিল।
জোচ্চুরি, জালিয়াতি কিংবা নকল জিনিস বিক্রি ছিলো মধ্যবিত্ত রোমান ব্যবসায়ীদের আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস। নকল মুদ্রা আর গহনায় ছেয়ে গিয়েছিলো প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের বাজার। কিছু ব্যবসায়ী তাদের ওয়াইনের মধ্যে সাগরের নোনা পানি ঢেলে দিতো, কেউ কেউ আবার ছিল বর্তমান সময়ের সুদখোরদের মতো, খুবই উচ্চহারে টাকা ধার দেওয়ার পর পরবর্তীতে সবকিছু কেড়ে নিয়ে একেবারে নিঃস্ব বানিয়ে ছাড়তো। তবে ধরা পড়লে তাদের জন্য শাস্তির বিধানও ছিল বেশ ভয়াবহ, তাদের সামাজিক অবস্থানের উপর ভিত্তি করে কয়েক গুণ টাকা জরিমানা থেকে শুরু করে জনসম্মুখে চাবুক মারাও হতো। এই শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য সওদাগর-ব্যবসায়ীরা আবার নিজেদের মধ্যে ট্রেড ইউনিয়ন কিংবা সমিতির প্রচলন ঘটিয়েছিল, যাকে বলা হতো ‘কলেজিয়া’। এই কলেজিয়ার ফলে নির্বিঘ্নে যেমন জোচ্চুরি চালানো যেত, তেমনিভাবে শাস্তি থেকেও রক্ষা পেতো তারা।
বাজারে পণ্য বিক্রয় করার মুহূর্ত; Source: Pinterest
অভিজাত রোমান সমাজেও অপরাধের কোনো কমতি ছিলো না। আদতে, অভিজাত সমাজে অপরাধের ধরণটা ছিল কিছুটা ভিন্ন। কুলীন জাতের রোমানদের চুরি কিংবা জালিয়াতি করার কোনো প্রয়োজন ছিল না। তারা জন্মেছেই সম্পদের পাহাড়ঘেরা জগতে, যা মধ্যবিত্তরা আকাঙ্ক্ষা করতো আর গরীবদের স্বপ্ন ছিল। তাদের জীবন ছিল সাধারণদের তুলনায় অনেক ভিন্ন, তাই অপরাধও ভিন্ন হওয়াটা স্বাভাবিক। আর এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রধান ছিল রাজদ্রোহিতা। সাম্রাজ্যের প্রধানকে সরিয়ে দিয়ে আরেকটু ক্ষমতা পাওয়ার চেষ্টা ছিল রোমান অভিজাত সমাজের মধ্যে প্রবল, বিশেষ করে রোমান রিপাবলিক যখন রোমান সাম্রাজ্যে রুপান্তরিত হওয়ার মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদল ঘটছে, তখন এ ধরনের অপরাধের মাত্রাও বেশ বেড়ে যায়।
অভিজাত রোমান পরিবারের কর্তৃত্ব থাকতো মূলত পিতার হাতে, তারপর বড় সন্তান, এভাবে একজনের অনুপস্থিতিতে তার পরবর্তী সন্তানের মধ্য দিয়ে পরিবারের কর্তৃত্বের হাতবদল ঘটতো। রোমান অভিজাত সমাজের সবচেয়ে খারাপ অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হতো প্যাট্রিসাইডকে। প্যাট্রিসাইড হচ্ছে কাউকে টাকার বিনিময়ে নিজের বাবা কিংবা পরিবারের প্রধানকে খুন করানো! এভাবে পরিবারের উত্তরাধিকার কিংবা টাকা-পয়সা খরচ করার ক্ষমতা তার হাতে চলে আসতো। ব্যভিচার করাও অভিজাত সমাজে অপরাধের চোখে দেখা হতো, কারণ এর ফলে পারিবারিক উত্তরাধিকার ব্যবস্থায় সমস্যা তৈরি হতো।
রোমান সমাজে অপরাধ ছিল সর্বত্র। আর অপরাধ কিংবা এর শাস্তি, অভিজাত-মধ্যবিত্ত বা গরীব, তিন শ্রেণির মধ্যে বিভেদ থাকলেও এর পিছনে ছিল একটাই কারণ- আরো টাকা, আরো কর্তৃত্ব, আরো ক্ষমতা।
Share To:

Naim Khan

Post A Comment:

0 comments so far,add yours